অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাবে বাংলাদেশে ৮০ ভাগ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে

10
.

বিদেশি সিরিয়ালগুলো যে ধরনের সংস্কৃতির ধারক-বাহক তা আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। বাংলা ট্রিবিউন আয়োজিত ‘বিদেশি সিরিয়াল সংস্কৃতির আপনপর’ শীর্ষক বৈঠকে এ দাবিই করেন বক্তারা।

মিথিলা ফারজানার সঞ্চালনায় এ বৈঠকে অংশ নিন নাট্যব্যক্তিত্ব ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) সভাপতি মামুনুর রশীদ, ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি গাজী রাকায়েত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক, দীপ্ত টিভির প্রধান নির্বাহী উরফী আহমদ, গ্রে অ্যাডভার্টাইজ লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার ও কান্ট্রি হেড গাউসুল আলম শাওন, সাংবাদিক উদিসা ইসলাম এবং বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল।

বৈঠকের শুরুতেই সংস্কৃতি কর্মীদের দাবি নিয়ে আলোচনা উঠে আসে। নাট্যব্যক্তিত্ব ও ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেন, ‘টেলিভিশন শিল্প সিনেমার চেয়েও বড়। একটি এক ঘন্টার নাটকে ২০ মিনিটের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। বিদেশে থেকে কলাকুশলী আনা হয়। আবার বিপুল পরিমাণ অর্থ ডাউনলিংকের মাধ্যমে বিদেশে চলে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয়, আমাদের মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। ভারতের কিছু চ্যানেলের সিরিয়াল এটি করছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘ইদানীংকালে দেশে শতকরা ৮০ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদের প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষ কারণ হলো ভারতীয় সিরিয়াল।’ তিনি সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করেন, ‘২০০৬ সালের সরকারি আইন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে মানতে হবে। বিজ্ঞাপনের অত্যাচার থেকে আমাদের বাঁচাতে হবে। বিদেশি শিল্পীদেরও আনার ক্ষেত্রে আইন মানতে হবে।’

বিদেশি সিরিয়াল প্রচার নিয়ে ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি ও নাট্যব্যক্তিত্ব গাজী রাকায়েত বলেন, ‘তথ্য মন্ত্রণালয়কে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে মোটামুটি বোঝাতে পারা যায়, কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট সিরিয়াল অনুমোদিত কিনা সেটি কী করে বুঝব। কারণ একটি নির্দিষ্ট কমিটি রয়েছে, যারা এই সিরিয়ালগুলোর ছাড়পত্র দেয়। সেই কমিটির ছাড়পত্র রয়েছে কিনা তা যাচাই করা উচিত।’ সে কারণে সম্প্রতি জারি করা তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘যতক্ষণ না ছাড়পত্র দেয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বিদেশি সিরিয়াল দেখানো যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, এসব বিদেশি সিরিয়াল কোন সময় প্রচার হবে সেটি নিয়েও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এফটিপিও’র কথা হয়েছে। এগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে প্রচার হচ্ছে কিনা তাও দেখতে হবে। নইলে শিল্পী সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সিরিয়াল প্রতি ৫ কোটি টাকা শিল্পী সম্মানী বাইরে চলে যাচ্ছে।

.

গ্রে অ্যাডভার্টাইজ লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার ও কান্ট্রি হেড গাউসুল আলম শাওন বলেন, ‘আমাদের টোটাল প্যাকেজ নিয়ে ভাবতে হবে। আমার মতে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কেউ রেসপন্সিবল না। বিজ্ঞাপন তারা কতক্ষণ চালাবেন এটা তাদের ব্যাপার। সিদ্ধান্ত তাদের নিতে হবে। দ্বিতীয় কথা, আজকের এ বিশ্বায়নের যুগে বড় বড় বাজেট নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। তাদের থামাবেন কীভাবে? আমাদের আন্দোলন হবে চ্যানেলগুলোর বিপক্ষে। জি-বাংলা বছরে ১শ কোটি টাকা নেয়। এভাবে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা মাটির নিচ দিয়ে চলে যায় সেটি নিয়ে আমরা কথা বলি না। আমরা পড়ে আছি ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে।’

মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এখন আমাদের দেশে ডেইলি সোপ নেই। সপ্তাহে পাঁচদিন চলে না। আপনারা যেভাবে কথা বলছেন, যেন আমরাই অপরাধ করে ফেলেছি। ধারাবাহিক নাটক যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন যে কত দরকার ছিল তা এখন কিছুটা হলেও বোঝা যায়। অনেক চ্যানেল বিদেশি সিরিয়াল বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক চ্যানেল ডেইলি সোপ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি বিটিভি ডেইল সোপ বানাচ্ছে।’ চ্যানেলগুলো মানসম্মত অনুষ্ঠান কেন বানাতে পারছে না এমন প্রসঙ্গ এনে তিনি আরও যোগ করেন, ‘আপনি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখুন, চ্যানেলগুলোর লাইসেন্স কীভাবে দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায়। শুধু ব্যবসা করার জন্য চ্যানেল দিয়েছেন তারা? আমার মনে হয় না।’ : এ সময় গাউসুল আলম শাওন আবারও বলেন, ‘এটা তো পাওয়ার গেম। আমার একটি চ্যানেল আছে, এমন প্রভাব খাটানোর জন্য।’ এ সময় বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কয়েকটি ছোট প্রশ্ন করেন। প্রথমেই বলেন, ‘আমি একটি কথা বলতে চাই, সুলতান সুলেমান কি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায়?’ :

.

মামুন বলেন, ‘এটা আমাদের সংস্কৃতির বিপক্ষে। একটা দৃশ্যের কথা বলি, যুবরাজ এসেছেন যুদ্ধ জয় করে। রাজমাতা তার বিশ্রামের জন্য হেরেমে যাওয়ার কথা বলল। কিন্তু যুবরাজ বলেন, আমার তিন স্ত্রী কেউ আমাকে শান্তি দিতে পারেন না। তখন রাজমাতা নতুন এক নারীর আনার কথা বলেন! এটা কীভাবে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায়?’ আপনি তো তাহলে নিজেও সিরিয়ালটা দেখেছেন, বলেন জুলফিকার রাসেল। তিনি আরও যোগ করে বলেন, আপনাদের শিল্পীরা ‘লিটনের ফ্ল্যাট’-এর কথা জানেন? ‘ব্যাচেলর’ ছবিতে এটা দেখানো হয়েছে। তখন কী এটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে গিয়েছে? তখন আপনারা আন্দোলন করেছেন? যখন টেলিভিশনে মুনমুন-ময়ূরীকে দেখাতো তখন কী আপনারা প্রতিবাদ করেছিলেন? মনে পড়ে না।

উত্তরে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ঐ পরিচালকের (মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) বিরুদ্ধেই আমরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার।’ গাজী রাকায়েত বলেন, ‘সংস্কৃতির সবচেয়ে ধারক-বাহক টেলিভিশন। সুলতান সুলেমান সিরিয়ালে শরীরের একটা জায়গায় শেড (ঝাপসা) করে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বাচ্চারা বলছে, বাবা ওখানে শেড কেন? আমরা বলতে পারছি না। এ ছাড়া ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দীপ্ত টিভিতে সাড়ে ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সুলতান সুলমান চলেছে। তাহলে কী করে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিত মজবুত হবে?’

দীপ্ত টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উরফী আহমদ বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সুলতান সুলেমান চলেছে। কিন্তু তার আগে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাড়ে ৯টা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান চালিয়েছি তা আপনারা লক্ষ করলেন না। আমরা সবকিছু ভেবেই এটা করেছি। কারণ এটা জনপ্রিয় একটি সিরিয়াল। মাত্র তিন ঘন্টা এ সময় বরাদ্দ ছিল।’

গাজী রাকায়েত বলেন, ‘আপনার কী করেছেন তা আমাদের রেকর্ড আছে। প্রাইম টাইম ৬টা থেকে ৯টা। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ নাটক অন্য চ্যানেলে চলেছে। কিন্তু সে সময় দীপ্ত টিভি চালিয়েছে সুলতান সুলেমান। ফলে অন্য নাটকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ জুলফিকার রাসেল বলেন, ‘আর একটা বিষয় এগুলো বিতর্কে সব সমাধান সম্ভব নয়। দর্শক আসলে কী ধরনের অনুষ্ঠান চাইছেন সে বিষয়ে আমাদের গবেষণা বাড়াতে হবে। কোন দেশে কীভাবে, কাদের জন্য কেমন সিরিয়াল দেখানো হচ্ছে, সে বিষয়েও গবেষণা জরুরি।’ শাওন এ সময় আরও কিছু তথ্য যুক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতীয়দের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি আর বাংলাদেশে ৩০-এর নিচের দর্শকরা মূলত সিরিয়ালগুলো দেখেন।

এগুলো নিয়েও আমাদের আরও গবেষণা করতে হবে।’ টেলিভিশনে মূল্যবোধ তৈরি নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। তিনি বলেন, ‘মিডিয়া পলিসি যারা প্রণয়ন করছে তাদের দূরদৃষ্টি থাকা দরকার। ভবিষ্যতে আমরা টেলিভিশন শিল্পকে কোথায় দেখতে চাই তা নিয়েও ভাবতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে একটা অনুষ্ঠানে কতক্ষণ বিজ্ঞাপন চলবে এটা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ঠিক করছে, কিন্তু এটি ঠিক করা উচিত সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মূল্যবোধ কিন্তু স্থির কোনো বিষয় নয়। সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে মূল্যবোধ। এখন মানছি না পরে সেটিকে মেনে নিচ্ছি। আর এটি মনে রাখতে হবে সংস্কৃতি কিন্তু উন্মুক্ত। টেলিভিশন ডাউনলিংক বন্ধ করতে পারবেন কিন্তু ইন্টারনেট ডাউনলিংক কী করে আটকাবেন? আপনি বাধা দিলেও দর্শক কিন্তু ভিন্ন সোর্স থেকে সেই জিনিস দেখে ফেলছে। তাহলে এখানে দর্শক রুচিই কিন্তু মুখ্য।’

বাংলা ট্রিবিউনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক উদিসা ইসলাম বলেন, ‘টেলিভিশন মূল্যবোধ তৈরি করে হয়ত কিছুটা, কিন্তু সেটা খুব বেশি বলে আমি মনে করি না। উত্তরা-তেজকুনিপাড়ায় কিশোর হত্যার ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি আমাদের সমাজের মূল্যবোধের জায়গায় ঘুণ ধরেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনাগুলোর পিছনে কি বিদেশি সিরিয়াল দেখা দায়ী? আমার প্রশ্ন হলো, মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে দেখেও এই মূল্যবোধের আন্দোলনে আপনারা বিলম্ব করলেন কেন?’ মামুনুর রশীদকে প্রশ্ন করে তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা শিক্ষা ধ্বংসের মুখে গেছে বলে শিক্ষকদের দায়ী করছেন, বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন কি ধ্বংস হয়ে যায়নি?

অনুষ্ঠান শেষ করেন মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘দর্শকরা টাকা দিয়ে চ্যানেলগুলো দেখছে। আমাদের ভালো একটা পরিবেশ আছে, শিল্পী আছে, কলাকুশলী আছে। আমাদের প্রতিভাগুলো কাজে লাগাতে চাই। আমাদের ব্রডকাস্টিং পলিসি নেই। এটা জরুরি।’ : সংস্কৃতিকর্মীদের আন্দোলন ও বিদেশি সিরিয়ালের দৌরাত্ম্যকে সামনে রেখে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মিডিয়া কর্মী, বিজ্ঞাপনদাতাসহ টেলিভিশন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়েই এই বৈঠক হয়। বৈঠকটি সরাসরি সম্প্রচার করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ’৭১।

১০ মন্তব্য
  1. Md Mannan বলেছেন

    100% সঠিক বলেছো সাইফুল,

  2. Salauddin Russel বলেছেন

    কুকুর বাচছা জন্য সমাজ ভাবে হেন্য হয়েছে

  3. Mohammad Kaysh বলেছেন

    Right 100%

  4. Apxn Monjur Morshed Rony বলেছেন

    সঠিক

  5. Kawsar Hosan বলেছেন

    একদিকে ভারতের হরেকৃষ্ণ মার্কা অশালিন লুইচ্চামিতে ভরা সিরিয়াল,এখন আবার নতুন করে বিভিন্ন দেশের সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে দেখানো হচ্ছে এই সব দেখার কেউ নেই, যারা দেশনিয়ে বড় বড় কথা বলে সেইসব জনদরদী আজ কোথায় নাকি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে, আশাকরি সংশ্লিষ্ট কত্বৃপক্ষ নজর দিয়ে ব্যাবস্তা নিবেন

  6. M.a. Kader বলেছেন

    জাতির বিবেক, এ কথা আন্নেরে কে কই ল।

    1. Saiful Islam Shilpi বলেছেন

      এটাতো কেউ বলা লাগে না। দেশের সব বিবেকবান মানুষ (আওয়ামী লীগ ছাড়া) এ কুফলের প্রভাব অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু আপনি কি আওয়ামী লীগের কাতারে পড়েছেন..? আপনি কেন ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের কুফল বুঝতে পারছেন না..?

    2. M.a. Kader বলেছেন

      জয় বাংলা।

    3. Saiful Islam Shilpi বলেছেন

      লীগ সামলা… 😛

  7. Sakil Shuva বলেছেন

    ভাবি জানে… 😛