অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

অনুভুতি সম্পন্ন কৃত্রিম হাত তৈরি করে বিস্ময় সৃষ্টি

0
CTG Raihan-01
যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা কিছু আবিস্কারে ব্যস্ত ক্ষুদে বিজ্ঞানী রায়হান।

হাত-পা বিহীন কোন মানুষের শরীরে কৃত্রিম অঙ্গ লাগানো হলেও সেই অঙ্গে কোন অনুভুতি থাকে না। কিন্তু অনুভুতি সম্পন্ন কৃত্রিম হাত তৈরি করে রীতিমত বিস্ময় সৃষ্টি করেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিস্ময় তরুন রায়হান চৌধুরী। রায়হান চৌধুরীর উদ্ভাবিত এই কৃত্রিম হাত কোন হাতবিহীন মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হলে এই হাত দিয়ে স্বাভাবিক হাতের মতোই অনেক কাজ করতে পারবেন হাতবিহীন ব্যক্তিটি এমনটি দাবী করেছেন এ ক্ষুদে বিজ্ঞানী।

শুধু কৃত্রিম হাতই নয়, রায়হান ইতিমধ্যে আবিস্কার করেছেন ভুমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা বা পূর্বাভাস দেওয়ার মতো সেন্সর ডিভাইস।

অটোমোবাইল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারী এই তরুন উদ্ভাবক তার এই উদ্ভাবন ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। কোন সরকারী বেসরকারী পৃষ্টপোষকতা ছাড়াই রায়হান চৌধুরী গত প্রায় ১৫ বছর ধরে নানা ডিভাইস উদ্ভাবনে গবেষনা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে রায়হান চৌধুরী বলেন, যাদের হাত নেই কেবল তারাই অনুভব করতে পারেন এই হাত না থাকার কষ্ট। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই অনুভুতিসম্পন্ন কৃত্রিম হাত তৈরির জন্য গবেষনা শুরু করি আমি।

Raihan-03
ক্ষুদে বিজ্ঞানী রায়হানের আবিস্কৃত অনুভূতি সম্পন্ন কৃত্রিম হাত।

রায়হান বলেন, আমি মাত্র একমাসের গবেষনা এবং নানা প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে একটি কৃত্রিম হাত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এই কৃত্রিম হাতটি হাতবিহীন মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা হলে এই হাতেও থাকবে অনুভুতি। কৃত্রিম হাতটি স্বাভাবিক রক্ত মাংসের হাতের মতোই কাজ করতে সক্ষম হবে।

রায়হান বলেন, সরকার বা কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে আমার তৈরি কৃত্রিম হাতকে সাধারণ হাতের মতোই অবয়ব দেওয়া সম্ভব হবে। আর ব্যাপক আকারে তা কার্যকর করা গেলে দুর্ঘটনায় যাদের অঙ্গহানি ঘটে, বদলে যাবে তাদের জীবন। স্বাভাবিক মানুষের মতোই তারা দৈনন্দিন কাজ সারতে পারবেন কৃত্রিম হাত দিয়ে।

রায়হান আরো বলেন আমার তৈরি কৃত্রিম হাত দিয়ে হাতবিহীন ব্যক্তি হ্যান্ডশেক করার ইচ্ছে পোষণ করলে সেটি করতে পারবেন, মুষ্টি করতে চাইলে মুষ্টিবদ্ধ করা যাবে। কোন জিনিস ধরতে চাইলে ধরতে পারবেন। কৃত্রিম এই হাতটি মস্তিষ্কের নির্দেশনা অনুযায়ী সব কাজই করতে সক্ষম বলে রায়হান দাবী করেন।

রায়হান জানান, প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২ ফুট দীর্ঘ এই কৃত্রিম হাতটি তৈরিতে সময় লেগেছে ১ মাস। এটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে লোহার শিক, গলানো প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রনিক্স সেন্সর আর মোটরসহ সাধারণ কিছু উপকরণ।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার অধিবাসী রায়হানের পিতা আলহাজ্ব নূরুল আলম বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীন আমদানি রফতানি বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সরকারী চাকুরি থেকে অবসর গ্রহন করেছেন। ৪ ভাই এক বোনের সংসারে রায়হানের পড়ালেখা এগিয়েছে অটোমোবাইল বিভাগের ডিপ্লোমা পর্যন্ত। রায়হান ২০০৮ সালে অগ্রাবাদ স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ওই বছর নাছিরাবাদ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ২০১০ সালে অটোমোবাইল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে উদ্ভাবনী গবেষনাতেই পার করছেন সময়।

রায়হান জানান, খুব ছোটবেলায় একটি রেডিও কেমন করে বাজে। রেডিও’র ভেতর কেমন করে গান বা কথাবার্তা শোনা যায়-এই কৌতুহলের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে গবেষনা শুরু করেন রায়হান। তার দীর্ঘ গবেষনায় ২০১০ সালে ‘মোবাইল প্রজেক্টরের’ মধ্য দিয়ে শুরু করেন উদ্ভাবন, এর পর দুই বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে ‘ট্রেন সেন্সর’ ও ব্যাংক ডাকাতি রোধে ‘লেজার গান সিস্টেম’ যন্ত্র আবিষ্কার করেন রায়হান। রায়হানের উদ্ভাবিত ট্রেন সেন্সর রেললাইনের যেকোন সমস্যা আগাম জানান দিতে সক্ষম। এই ডিভাইসের মাধ্যমে রেললাইনের কোথাও ফিসপ্লেট খুলে ফেলা হলে এই বিশেষ সেন্সর ট্রেনের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে সক্ষম হবে এবং মোবাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠাবে। এ ছাড়া রায়হান চলতি বছর ভূমিকম্প পূর্বাভাস যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। রায়হান জানান, সারাবিশ্বে এখনো ভুমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়ার কোন যন্ত্র আবিস্কৃত না হলেও তার আবিস্কৃত ডিভাইস ভুমিকম্পের কয়েক মিনিট পূর্বে মোবাইলে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হবে। মোবাইল রিংটোনের মাধ্যমে ভুমিকম্পের পূর্বাভাস দিবে রায়হানের যন্ত্র।

রায়হান জানান, আমার আবিস্কৃত ডিভাইসটির একটি অংশ মাটির গভীরে পুঁতে রাখা হলে লেজার রশ্মির মাধ্যমে উপরে থাকা অপর একটি অংশে বার্তা পাঠাবে। যা একইসঙ্গে সঙ্কেত আর মোবাইল ফোনে রিংটোনের মাধ্যমে অবহিত করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে। যত বেশি গভীরতায় যন্ত্রটি স্থাপন করা যাবে তত দ্রুত ভূমিকম্পের আগাম বার্তা জানা যাবে।

এর আগে ২০১২ সালে রায়হান আবিষ্কার করেন ‘লেজার সিকিউরিটি ডিভাইস’। তার আবিস্কৃত এই যন্ত্রটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় লেজারের সাহায্যে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। রায়হারের আবিস্কৃতি যন্ত্রটি যে যায়গায় স্থাপন করা হবে নির্ধারিত ওই জায়গায় অবৈধ কেউ প্রবেশ করলেই স্বয়ংক্রিয় মোবাইল কলের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিবে ডিভাইসটি।

রায়হান জানান, গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে তার আবিস্কার এবং গবেষনায় প্রায় ১৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছেন। তার এযাবতকালের আবিস্কার এবং উদ্ভাবনী গবেষনায় যাবতীয় খরচ দিয়েছেন তার বড় ভাই মেরিন প্রকৌশলী এম জি দস্তগির চৌধুরী। সরকারী বেসরকারী কোন পৃষ্টপোষকতা না পেলেও রায়হান এখনো তার গবেষনা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তার পরিবারের উৎসাহে।

রায়হানের মা আমেনা বেগম জানান, রায়হান তার নাওয়া-খাওয়া ভুলে সার্বক্ষনিক গবেষনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এমনও দেখা গেছে সে দিন রাত টান ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত তার ছোট্ট ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা তাকে যতটুকু পারি সাহায্য করছি। আমেনা বেগম বলেন আমরা চাই রায়হানের আবিস্কার দেশ ও দেশের মানুষের কল্যানে কাজে লাগুক। একটু সরকারী বেসরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে রায়হান অনেকদুর এগিয়ে যাবে বলে আমেনা বেগম মন্তব্য করেন।