অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

মানবাধিকার দিবসের ভাবনা

0
.

জিয়া হাবীব আহসান
আজ ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস । মানবাধিকার দিবস জাতিসংঘের আহবানে বিশ্বের সকল দেশে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ সাল থেকে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। এছাড়াও, ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাকে’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ দিবসটি পালন করা হয়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নবরূপে সৃষ্ট জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ অর্জন। ৪ ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১৭তম পূর্ণ অধিবেশনে ৪২৩(৫) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সদস্যভূক্ত দেশসহ আগ্রহী সংস্থাগুলোকে দিনটি তাদের মতো করে উদযাপনের আহবান জানানো হয়। মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন ধরণের তথ্যচিত্র কিংবা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী প্রধানতঃ এ দিবস পালনের মাধ্যমে । ঐতিহ্যগতভাবে ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার ক্ষেত্রে পুরস্কার’ প্রদান করা হয় । এছাড়া নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান কার্যক্রমও এদিনেই হয়ে থাকে। দিবসটি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত এবং আমাদের দেশ সহ বিশ্বের সর্বত্র পালিত হয় । কিন্তু, দক্ষিণ আফ্রিকায় শার্পেভিল

স্মরণ করে দিবসটি উদযাপিত হয় ২১ মার্চ । জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত এই চার্টারে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ । আমাদের পবিত্র সংবিধানেও মানবাধিকারের বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে ।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩য় বিভাগের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ সমূহে এই সকল অধিকার প্রতিস্থাপিত হয়েছে । যেমনঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, গৃহ ও যোগাযোগ রক্ষণের অধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, চলাফেলার স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি ।

বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন সমূহ সংবিধানের সহিত এই সকল ধারা বা অনুচ্ছেদের যতটুকু সাংঘর্ষিক ততটুকু বাতিলযোগ্য। তাছাড়া বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশে পর্যাপ্ত স্পেশাল ’ল প্রনয়ন করা হয়েছে এবং সাধারণ আইনের উপর এই সকল বিশেষ আইন প্রধান্য পাবে মর্মেও আইনে উল্লেখ আছে।

যেমনঃ পারিবারিক সহিংস আইন ২০১০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩, পারিবারিক আদালত অর্ডিনেন্স ১৯৮৫, শিশু আইন ২০১৩, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩ উল্লেখযোগ্য।

এত ভালো ভালো আইন আমাদের দেশে থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কমছে না । বিশেষ করে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, বৈবাহিক প্রতারণা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, পাচার, যৌন হয়রানী, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড সন্ত্রাস, টর্চার, খুন, গুম ইত্যাদি অপরাধের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার সবচেয়ে মূল্যবান একটি অধিকার । আমাদের দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রচন্ড শৈতল্য বিদ্যমান। বিচারক সংকট, তদন্ত কাজে গাফিলতি, স্বাক্ষী ও ভিকটিমের নিরাপত্তা, দীর্ঘসূত্রিতা, রাজনৈতিক প্রভাব প্রভৃতি কারণে আমাদের দেশে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বড় বাধা।

বিচারক সংকটের কারণে বছরের পর বছর মামলা শেষ হয় না। ফলে বিচার প্রার্থী মানুষ চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের থেকে বিচারক নিয়োগের বিধান কার্যকর নেই। একটি নারী তার মোহরানা, খোরপোষ ও সন্তানের অধিকার আদায়ের মামলায় বছরের বছর আদালতে ঘুরতে হয়। সরকারের লিগ্যাল এইড কার্যক্রম এখনো জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি।

মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী যেভাবে আইনী সহায়তা পাওয়ার কথা সেভাবে কি তারা পাচ্ছে ? মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের পদটি মহামান্য উচ্চ আদালতের বিচারকের মর্যাদার সমতুল্য হলেও কার্যক্ষেত্রে তিনি সেভাবে ক্ষমতা ভোগ করছেন না। প্রতিবন্ধী ও হিজরা জনগোষ্ঠীকে আমরা মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে পারিনি। একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে এখনো যৌতুকের কারণে বলি হতে হয় আমার কন্যাকে, আমার বোনকে। এটাও জাতির ললাটে লজ্জা নয় কি? এবারের ডিসেম্বর মাস আমাদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই মাসেই আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এই মাসেই অর্জিত হয়েছিল। তাই ১০ই ডিসেম্বর ও ১৬ই ডিসেম্বর একই সূত্রে গাঁথা। এবারের ডিসেম্বর আরো একটি কারণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ৩০ই ডিসেম্বর নাগরিকদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব মতামত ও সরকার গঠনে ভূমিকা রাখবে এই নির্বাচন যা এদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে । এই নির্বাচনকে নিয়ে যত জল্পনা কল্পনা হোক না কেন এই নির্বাচনে সর্বাধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে। যা দেশের জন শুভ লক্ষণ। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার যেন নিরঙ্কুশ হয় সে ব্যাপারে সকলকে সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে। আমার ভোট আমি দেব, আপনার ভোটও আমি দেব এমন নির্বাচন যেন না হয়। দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারকে যথাযত যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে। ই.ভি.এম মেশিনে ভোট প্রয়োগ আমাদের সংবিধান সম্মত নয় মর্মে অভিযোগ উঠেছে। এই বিতর্কের অবসানে নির্বাচন কমিশনকে ভোটারদের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার এক জিনিস নয়। যেমনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন ও সংবিধানে এতই সুরক্ষিত যে মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়ে তাদের আলাদা করে ভাবতে হয় না। আমরা যেখানে নাগরিক অধিকারই সুরক্ষিত করতে পারলাম না সেখানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সুদূর পরাহত। এই জন্য মানবাধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি জাতির ঐক্যমত্য সৃষ্টি হওয়া দরকার। নইলে জাতিসংঘের মানবাধিকার চার্টারে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে এবং লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আসুন বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ও বিজয় দিবসকে শুধুমাত্র র‌্যালি, সেমিনার, মানবন্ধন, পদক বিতরণ, গুণীজন সম্মর্ধনা ইত্যাদির মাধ্যমে সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সারা বছর ব্যাপী বাস্তব কর্মসুচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করি। জয় হোক মানবতার, জয় হোক স্বাধীনতার।

লেখকঃ আইনজীবী,কলামিস্ট,মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।