অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও কর্ণফুলির তীরে অবৈধ মৎস্য বাজার উচ্ছেদ হচ্ছে না

0
.

চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর দুইপাড়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠা অসংখ্য স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও রহস্যজনক কারণে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে বহাল তবিয়তে রয়েছে সরকারী জায়গায় গড়ে উঠা বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের অবৈধ মৎস্য আড়তটি। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশ মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

হাইকোটের্র সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও কেন অবৈধ মৎস্য বাজারটি ভাঙ্গা বা উচ্ছেদ হচ্ছে না সে প্রশ্ন সচেতন মহলের।

আদালত সুত্রে জানাগেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষই নদী তীরের জায়গা অবৈধভাবে লিজ দিয়েছে একটি সমিতিকে। শতকোটি টাকা মূল্যের চার একর ভূমি চার কোটি ২২ লাখ টাকায় ১৫ বছরের জন্য লিজ নিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য বাজার। নেওয়া এ জায়গায় ১৮৮টি কক্ষ দিয়ে সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছে মৎস্য আড়ত। ভূমি অফিসের সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার জরিপ করে অবৈধ জায়গায় এ আড়ত গড়ে উঠেছে বলে রিপোর্ট দিয়েছেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও তাদের রিপোর্টে অবৈধ এ আড়ত উচ্ছেদের কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত দুই হাজার ১৮১ স্থাপনার মধ্যে রাখা হয়নি এ মৎস্য আড়ত। উচ্ছেদ অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠছে শুরুতেই।

.

জানাগেছে, বাকলিয়া থানার মৌজা বাকলিয়া চাক্তাই রাজাখালী নতুন ফিসারীঘাট বিএস খতিয়ান নং ০১, বিএস দাগ নং৮৬৫১, জমি -৪.০০ একর জায়গার উপর কোন ধরণের স্থপনা নির্মানে হাইকোর্টের স্থিতিবস্থা বাজায় রাখার দিলেও (স্বারক নং-৯৮৪ তাং৩০ জুন ২০১৮ ইং মএবং ১৭২৮ তাং০৮/০৯/২০১৬ নির্দেশ অমান্য করে উক্ত জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিঃ এর চেয়ারম্যান এ এফ এম মাসুক নাজিম গং। এই বেআইনী কাজ বন্ধ রাখার জন্য বিবাদী মোহাম্মদ শাহজাহান প্রশাসনের কাছে বার বার ধর্না দিলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ কিংবা বেআইনী স্থাপনা উচ্ছেদে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন আবেদনকারী শাহজাহান।

এদিকে সম্প্রতি ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, নতুন করে ভবন নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে। ওইখানে ছয়টি কক্ষের একতলা ভবনে আস্তর দেওয়ার কাজ করছিল পাঁচজন শ্রমিক। আবার একই সময়ে ফিশারিঘাটের মাঝামাঝি পয়েন্টে একতলা একটি ভবনকে দ্বিতল করার কাজ করছিল ১৫ জন শ্রমিক। মাঝিরঘাটে যখন নদীতীর থেকে ১০০ ফুট দূরের স্থাপনাও ভাঙা হচ্ছিল, তখন ফিশারিঘাটের এসব নতুন স্থাপনা তৈরি হচ্ছিল নদীতীরের ৪০ ফুটের মধ্যেই। অভিযান পরিচালনা করা সংস্থার এমন দ্বৈত ভূমিকায় নাখোশ সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, এক নদীর জন্য দুই আইন হতে পারে না। নিজেদের অবৈধ স্থাপনা অক্ষত রেখে অন্যের স্থাপনা ভেঙে দিলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে এ উচ্ছেদ অভিযান।

এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী নদীর গবেষক অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। যে সংস্থা উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে আছে, তারা নিজেরাই যদি আইন ভঙ্গ করে নদীতীরে অবৈধ জায়গা লিজ দেয়, তবে সাধারণের মধ্যে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নিজের অবৈধ জায়গা অক্ষত রেখে অন্যের জায়গায় বুলডোজার চালালে পুরো অভিযানই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন তালিকা করেছিলাম, তখন এটি মৎস্য আড়ত ছিল না। তারপরও মৎস্য আড়তের সামনের কিছু অংশ অবৈধ হিসেবে মার্ক করা হয়েছে। কেন এ জায়গার পুরোটা অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি- তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে পুনরায় জরিপ করব আমরা।’

.

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি এস্টেট অফিসার জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বন্দর চ্যানেল হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। এটির শাসন, খনন, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত। সাধারণত কর্ণফুলী নদীর হাই ওয়াটার মার্ক (সাধারণ জোয়ারে নদীর পানি যে সীমানা স্পর্শ করে) ১৫০ ফুট পর্যন্ত বন্দরের এখতিয়ারে। তা ছাড়া নদীকেন্দ্রিক যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করে, তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাও বন্দরের কাজ। এ চিন্তা থেকেই জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে জায়গাটি লিজ দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি বন্দরের বৈধ জায়গা।’

অথচ জরিপ করে বন্দর ভূমি অফিস সদর সার্কেলের সহকারী কর্মকর্তা খোরশেদুল আলম মৎস্য আড়তের জায়গাটি নদীর তীর দখল করে নির্মিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছেন। আবার ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে একটি প্রতিবেদন দেন সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আছিয়া খাতুন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মধ্যবর্তী স্থানের যে জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে, তা ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত নদী শ্রেণির জমি। খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গা কী বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারা বা ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেছে, তা বোধগম্য নয়।

বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ১৫ বছর মেয়াদে জায়গা ইজারা নিয়ে এই মৎস অবতরণকেন্দ্রটি তৈরি করে ব্যবসায়ীরা। যদিও শুরু থেকে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

তবে এই কেন্দ্রটি কোনভাবেই রাখা যাবেনা বলে জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি সংবাদিকদেও জানান, নদীর জায়গায় কোন স্থাপনা থাকতে দেয়া হবেনা। তবে, নিজ দায়িত্বে স্থাপনা সরিয়ে নিতে মৎস অবতরণকেন্দ্রের ব্যবসায়ীদের নতুন করে সময় বেধে দেয়ার কথাও জানান তিনি।

এদিকে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পরও ইজারার বাইরে নদীর জায়গা দখল করে নিয়মিতই নতুন নতুন দোকান বানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তৈরি করেছেন মসজিদও।