রমজান মাসে করোনা থেকে সুস্থ থাকতে আমাদের করনীয় – ডাঃ শাহাদাত হোসেন
ডা. শাহাদাত হোসেনঃ
সবাইকে পবিত্র রমজান মাসের মোবারকবাদ। সংযম ও সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান আমাদের মাঝে সমাগত। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। ভয়াল এ মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও। তাই আজকে আমি আপনাদের কাছে লিখছি সচেতনতামুলকভাবে যাতে আপনারা করোনা থেকে সুরক্ষিত থেকে যথাযথ মর্যাদার মধ্য দিয়ে রামাদানুল কারিম পালন করতে পারেন।
আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্যজনিত বদঅভ্যাসগুলির দিকে তাকাই তাহলে দেখি যে, আমাদের একটি জাতীয় অভ্যাস হলো যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলা। বিশেষ করে, রমজান মাসে এটি আমাদের রাস্তা-ঘাটে, অফিস, আদালতে, মার্কেট, হাসপাতাল বা অন্যান্য পাবলিক প্লেসের খুবই পরিচিত দৃশ্য। এই অভ্যাসটি যতটা না রুচিহীন, তার থেকেও বেশী বিপদজনক। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশি সহ থুতু থেকেও ছড়াতে পারে। আমরা জানি যে এটি করোনা ছড়ানোর একটি অন্যতম প্রধান উপায়। মাটিতে পড়ে থাকা কফ-থুথু আমাদের পায়ের জুতা, স্যান্ডেল ও নিচের দিকের পরিধেয় কাপড়ে লেগে গিয়ে করোনার সংক্রমণ অনেক বাড়িয়ে দিবে।শুধু করোনা ভাইরাস না, অনেক ধরণের রোগ-জীবাণু থুতুর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। প্রকাশ্যে কাউকে থুতু ফেলতে দেখলে সাবধান করা উচিৎ। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এইরকম সচেতনতাই আমাদের একমাত্র হাতিয়ার।
এখানে উল্লেখ্য যে, যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলার কারণ হিসাবে অনেকে বলেন যে, মুখ-গহ্বরের যে নিঃসরণ (লালা, থুথু ইত্যাদি) তা রোজা রেখে গিলে ফেললে রোজা ভেঙ্গে যায়, যা ধর্মীয়ভাবে মোটেও সঠিক নয়। এ ব্যাপারে পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন প্রফেসর ডা. শারমিন ইয়াসমিন বলেন যে, এই নিঃসরণ শরীরের জন্য উপকারী। এই নিঃসরণে থাকে রোগ প্রতিরোধক অনেক দরকারি পদার্থ-যেমনঃ অ্যান্টিবডি, এনজাইম, ভাল জীবাণু ইত্যাদি। এগুলো আমাদের মুখগহ্বর ও দাঁতের স্বাস্থ্য ভাল রাখে, খারাপ জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে তাঁদের শরীরে প্রবেশ প্রতিহত করে। তাছাড়া এই নিঃসরণ পাকস্থলীতে গিয়ে আমাদের এসিডিটির সমস্যা, ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স, মুখের দুর্গন্ধ ইত্যাদি দূর করে। বারবার থুথু ফেললে আমাদের মুখের ভিতরটা শুকিয়ে যাবে আর আমাদের ঘন ঘন পানি পিপাসা পাবে।
এ ছাড়াও আমরা দেখি যেএখন সবাই কমবেশী মাস্ক ব্যবহার করছে। জনগণ মোটামোটি সচেতন এবং আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে মাস্ক ব্যবহারের সাথে সাথে একটা বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেটা হলো হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় বা কারও সাথে কথা বলার সময় মাস্ক সাময়িকভাবে খুলে ফেলা। আপনার মাস্কটি যতটা আপনাকে বাইরের জীবাণু থেকে রক্ষা করছে, ঠিক ততটাই অন্যদের রক্ষা করছে আপনার শরীরের জীবাণু থেকে। সুতরাং, হাঁচি-কাশি আসলে, হাঁচি-কাশিটি মাস্কের ভিতরেই দেয়া উচিৎ যাতে আপনার জীবাণু বাইরে না ছড়ায়। উপরন্ত, কথা বলার সময় থুতুর ছিটা থেকেও করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। সুতরাং কথা বলার সময়েও মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ।
করোনা মোকাবিলায় এই রমজান মাসে করণীয় সম্পর্কে পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন থেকে নিম্নোক্ত নিয়মাবলী মেনে চলতে বলা হয়-
১) মুখের লালা, থুথু বাইরে ফেলবেন না বরং তা গিলে তার উপকারসমূহ শরীরের রোগসমূহ প্রতিহত করার জন্য কাজে লাগান।
২) হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলুন। অর্থাৎ হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু, রুমাল বা পরিস্কার কাপড় ব্যবহার করুন। এগুলো না থাকলে হাতের কনুই দিয়ে মুখ ঢাকুন। ব্যবহারের পর টিস্যু বা কাপড় একটি ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলবেন। তারপর হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন।
৩) রমজান মাসে তারাবীর নামাজ বাড়িতেই পড়বেন, যেই পর্যন্ত সরকার থেকে এই ব্যপারে কোন সুনির্দিষ্ট আদেশ জারি না হয়।
৪) যে কোন ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় জমায়েত (একত্রে তারাবীর নামাজ পড়া), ইফতার পার্টি ইত্যাদি করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন।
৫) এই মাসে বাড়তি এবাদতে আমাদের অনেক উপকার। এতে বার বার অযু করার ফলে শরীরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা পূর্বের চাইতেও বেশি বজায় রাখা যায়, আবার শরীরের জন্য ব্যায়ামও হয়। এগুলো করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জরুরী বিষয়। এছাড়া এতে মানসিক স্বাস্থ্যও আমাদের ভাল থাকবে।
৬) অকারণে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে বাড়িতে অবস্থান করতে হবে এবং সরকারের লকডাউন এর নির্দেশাবলী পালন করতে হবে। এই সময়ে তা কিছুটা সহজ হবে আশা করা যায়। কারণ খালি পেটে বাইরে, রোদের মধ্যে অযথা অনেকেই বের হতে চাইবেন না।
৭) ঘরে থেকে একে অন্যকে সাহায্য করে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন বাড়ানোর এটিই উপযুক্ত সময়।
৮) ঘরের তৈরি খাবারে ইফতার আয়োজন করবেন। যা স্বাস্থ্যকর এবং উপাদেয়। রোজা খোলার পর প্রচুর পানি ও পানীয় জাতীয় খাবার, ফল ইফতারের আয়োজনে রাখবেন। পরিমিত খাবেন, কারণ আপনার বাড়িতে বা দেশের যে কোন অপ্রত্যাশিত ও জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হলে যাতে খাদ্য সংকটে না পড়তে হয়।
৯) সকল স্থানে, অফিসে, হাসপাতালে বা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যেখানে সেখানে কফ-থুথু না ফেলার আদেশ দিয়ে এর সাথে করোনা সংক্রমণের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে সকলকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে তা কার্যকর করতে হবে।
১০) একই সাথে ব্যবহৃত টিস্যু, অন্যান্য বর্জ্য ফেলার জন্য ঢাকনাযুক্ত বিন বা কন্টেইনার অবশ্যই সরবরাহ করবেন এবং তা সময়মত পরিস্কার ও নিষ্কাশনের (ডিসপোজালের) ব্যবস্থা করতে হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকেই।
তাই আসুন এই পবিত্র মাসে আমরা সংযমের মধ্য দিয়ে করোনার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে সমাজ জীবনে শান্তি, স্বস্তি ও ইনসাফ ফিরে আসুক -এই হোক পবিত্র রমজান মাসে আমাদের প্রার্থনা। আমি মাহে রমজানে সকলের সুখ-শান্তি ও কল্যাণ কামনা করি।
লেখক: ডাক্তার শাহাদাত হোসেন।
চসিক মেয়র প্রার্থী ও সভাপতি- জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), চট্টগ্রাম মহানগর।