অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

রক্তকণিকা সৃষ্টিতে ফুসফুসের কার্যকরী ভূমিকা

0

শুধু অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারো (bone marrow) নয়, রক্তকণিকার একাংশ ফুসফুসেও সৃষ্টি হতে পারে। সাম্প্রতিক চমকপ্রদ গবেষণা।

মানবদেহে সংবহনতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি রক্ত আসলে  প্লাসমা ও রক্তকণিকার সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লাসমায় থাকে নানা প্রকার প্রোটিন যারা শারীরিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।  আর রক্তকণিকা মূলত সৃষ্টি হয় অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে। অস্থিমজ্জায় অবস্থিত বিশেষ রক্তজনিতৃকোষ নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টিতে প্রধানত অংশ নেয়l লোহিতরক্তকণিকা, শ্বেতরক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা এই তিন প্রকার রক্তকণিকার মধ্যে, রক্ত জমাট বাঁধতে, অণুচক্রিকা (platelets) বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাই অণুচক্রিকার সংখ্যা খুব কমে গেলে শরীরে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই অণুচক্রিকাই আজকের গল্পের প্রধান চরিত্র।

ডেঙ্গু, মাম্পস,  রুবেলা, চিকেনপক্স, হেপাটাইটিস-সি, এইডস ভাইরাস, এদের সংক্রমণে অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে রক্তে অণুচক্রিকা (platelets) সৃষ্টি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। এছাড়া, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া বা প্যানসাইটোপেনিয়া রোগে, লিউকেমিয়া এবং লিম্ফোমা জাতীয় ক্যান্সারে এমনকি ভিটামিন বি-12 ও ফোলিক অ্যাসিড-এর স্বল্পতায় অস্থিমজ্জা থেকে খুব কম পরিমাণে অণুচক্রিকা তৈরী হয়। কিন্তু অণুচক্রিকা যে শুধু অস্থিমজ্জাতেই তৈরী হয়না, সম্প্রতি তার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি গবেষণায়। এই গবেষণার হাত ধরে পরবর্তীকালে হয়ত এইসব রোগীদের দেহে অণুচক্রিকার সংখ্যা (platelet count) বৃদ্ধি করার উপায় বেরোতে পারে।

অণুচক্রিকা আমাদের শরীরে কেন জরুরি? ইটালিয়ান বৈজ্ঞানিক জুলিও বিসসেরও প্রথম রক্তে অণুচক্রিকার উপস্থিতি ও তার কাজের বিবরণ দেন [১]। অণুচক্রিকা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ থ্রম্বোপ্লাস্টিন, রক্তে অবস্থিত ফাইব্রিনোজেন ও প্রোথ্রোম্বিন, এই দুই প্রোটিন-এর উপস্থিতিতে রক্ততঞ্চন বা রক্তকে জমাট বাঁধানোর কাজে বিশেষ ভূমিকা নেয়। মানবদেহে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে গেলে থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া নামে রোগ সৃষ্টি হয় এবং কেবলমাত্র রক্তপরিসঞ্চালনের মাধ্যমে বাইরে থেকে শরীরে প্রয়োজনীয় অণুচক্রিকার যোগান দিলে তবেই এই রোগের উপশম সম্ভব।

গবেষণায় দেখা গেছে, অণুচক্রিকা অস্থিমজ্জায় অবস্থিত বৃহৎ আকৃতির মেগাক্যারিওসাইট কোষ থেকে তৈরী হয়। অস্থিমজ্জা ছাড়াও শরীরের অন্যান্য অঙ্গস্থান থেকে অণুচক্রিকা সৃষ্টিপদ্ধতি এবং সৃষ্টিস্থান নির্ধারণের কাজে বৈজ্ঞানিকরা বহুদিন ধরে গবেষণা করে চলেছেন। যেমন ফুসফুস। মানবদেহে নিশ্বাস-প্রশ্বাস ও শ্বসনকার্যের জন্যে ফুসফুস অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। দেখা গেছে, সংবহনের  সময় যে রক্ত ফুসফুসে প্রবেশ করে তাতে উপস্থিত অণুচক্রিকার সংখ্যার তুলনায়, ফুসফুস থেকে বেরনোর সময়ের রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা অনেক বেশী। সেই কারণে, বিজ্ঞানীরা ফুসফুসে অণুচক্রিকা সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী এল. আস্কফ-এর নাম উল্লেখ্য। বিজ্ঞানী আস্কফ বহুদিন আগেই ফুসফুসে মেগাক্যারিওসাইট এর উপস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে গেছেন [২]। পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে বার করেন যে সমস্ত শারীরিক অসুস্থতায়  রক্তকণিকার উপর প্রভাব পড়ে (যেমন ভাইরাল ইনফেকশন,  অ্যানিমিয়া, ক্যান্সার), সেই অসুস্থতার সময়ে অস্থিমজ্জা থেকে মেগাক্যারিওসাইট ফুসফুসীয় কলা ও রক্তজালিকায় সংবহন পথে চলে আসে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে “স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ঘটনা” বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ, এর জন্য আলাদা কোনো স্টিমুলাস-এর প্রয়োজন হয়না। কিন্তু কিভাবে যথেষ্ট পরিমাণে অণুচক্রিকা ফুসফুস থেকে উৎপন্ন হয়, সেই ধারণা যথোপযুক্ত গবেষণালব্ধ প্রমাণের অভাবে অসম্পূর্ণ ছিল।

সাম্প্রতিককালে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর মার্ক. আর. লুনির  তত্ত্বাবধানে গবেষকরা ইঁদুরের উপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন যে, ফুসফুস থেকে সরাসরি যথেষ্ট পরিমাণে অণুচক্রিকার সৃষ্টি হতে পারে। তারা “ইন্ট্রাভাইটাল মাইক্রোস্কোপিক ইমেজিং”-এর  সাহায্যে ইঁদুরের ফুসফুসের কোষীয় গমনপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করেনl গবেষকরা অণুচক্রিকা ও রক্তজনিতৃকোষগুলিকে তাদের কোষীয় মার্কার অনুযায়ী, “ফ্লুওরোসেন্স লেবেলিং” এর সাহায্যে চিহ্নিত করেন যাতে রক্তপরিবহন পথে কোষগুলির উপস্থিতি এবং তাদের নির্দিষ্ট গতিপথের ভিডিও রেকর্ডিং করে সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। ফুসফুসীয় রক্তসঞ্চালনের ভিডিও রেকডিং থেকে বৈজ্ঞানিকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে,  অস্থিমজ্জার মেগাক্যারিওসাইট সরাসরি ফুসফুসীয় সংবহন পথে চলে আসে এবং সেখানে যথেষ্ট অণুচক্রিকার সৃষ্টি করে। ফুসফুসে সৃষ্ট নতুন অণুচক্রিকা ফুসফুসীয় সংবহন থেকে বার হয়ে মূল রক্তসংবহন পথে চলে আসে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে, সম্পূর্ণ অণুচক্রিকার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ফুসফুস থেকে তৈরী হয়! গবেষকদের এই অভিনব পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা বিশ্ববিখ্যাত “নেচার” ও “ব্লাড” গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে [৩,৪]l

এছাড়া, গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে, উপরে উল্লিখিত নানান কারণে যখন  রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ বিশেষ ভাবে কমে যায়, তখন পরিণত ও অপরিণত যে মেগাক্যারিওসাইট কোষগুলো ফুসফুসের কলার বাইরের খাঁজেখোঁজে (extravascular space) থাকে, তারা সংবহন পথে পৌঁছে যায় অস্থিমজ্জাস্থানে এবং রক্তে পুনরায় অণুচক্রিকার সংখ্যা সার্বিক ভাবে বৃদ্ধি করে রোগপ্রশমনে সাহায্য করে l নিঃসন্দেহে এই আবিষ্কার বিজ্ঞান গবেষণায় রক্তজনিতৃকোষ ও অণুচক্রিকা সম্বন্ধীয় নানা রোগের শারীরবৃত্তিয় কার্য-কারণ ও সার্বিক নিরাময়ের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।