অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক: ছোট দুর্নীতিবাজকে সরিয়ে বসানো হল বড় দুর্নীতিবাজকে

0
.

দেশে করোনা মহামারির মধ্যে নানা ইস্যুতে আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে আছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও উঠেছে নানা অভিযোগ। ইতিমধ্যে সরিয়ে দেয়া হয়েছে কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে। এবার করোনা সংশ্লিষ্ট জরুরি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব করায় অধিদফতরের আরেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা ডা. মো. ইকবাল কবিরকে পরিকল্পনা ও গবেষণার শাখার পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। পরবর্তী পদায়নের জন্য তাকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পার-১ অধিশাখায় ন্যস্ত করা হয়েছে। সোমবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব (পার-২) শারমিন আক্তার জাহান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। শুধু পরিচালকের পদ থেকেই নয়, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় চলমান দুটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পদ থেকেও ইকবাল কবিরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের অধীনে পিপিই, ভেন্টিলেটর, মাস্ক, গগলসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি খরচ প্রস্তাব করেছেন ইকবাল কবির। খরচের প্রস্তাবে ৫ শ টাকার গগলস ৫০০০, ২ হাজারের পিপিই ৪৭০০ টাকা দাম দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসা সরঞ্জামে যত টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার চেয়ে তুলনামূলক বেশি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে। এ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় সরকার নড়েচড়ে বসে। সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই অধ্যাপক ডা. মো. ইকবাল কবিরকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিকল্পনা ও গবেষণা শাখার পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

কিন্তু ইকবাল কবিরকে কেনাকাটায় অস্বাভাবিক খরচের পরিকল্পনা বা প্রস্তাব করার দায়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরিয়ে দেয়া হলেও তার চেয়েও বড় দুর্নীতিবাজকে একইদিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। আর তিনি হলেন ডা. মুনশী মো. ছাদুল্লাহ। নিটোরের যুগ্ম পরিচালক থেকে তাকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লোভনীয় পোস্ট বা টাকা পয়সার জায়গা হিসেবে পরিচিত প্ল্যানিং, মনিটরিং ও রিসার্চের লাইন ডিরেক্টর হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। অথচ এই মুনশী মো. ছাদুল্লাহকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কোটি কোটি টাকা হরিলুটের দায়ে গত বছর অধিদফতর থেকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিলো। ওই লুটপাটের ঘটনা তদন্তে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ মুজিবর রহমানের (অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও শৃঙ্খলা) নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়।

কমিটিকে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হলেও তা কৌশলে এখন পর্যন্ত ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সূত্র বলছে, এই মুনশী মো. ছাদুল্লাহ মূলত স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি ডা. আবুল কালাম আজাদ সিন্ডিকেটের সদস্য। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন প্রকল্পের কেনাকাটার অর্থ মূলত প্ল্যানিং, মনিটরিং ও রিসার্চের লাইন ডিরেক্টরের হাত হয়েই যাবে। যে কারণে দুর্নীতির দায়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে শাস্তিমূলক বদলি হওয়ার পরেও এই পদে দুর্নীতিবাজ মুনশী মো. ছাদুল্লাহকে পদায়ন করেছে ডিজি সিন্ডিকেট। অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা হরিলুটের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে শাস্তিমূলক বদলির আগে মুনশী মো. ছাদুল্লাহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে ছিলেন। গত বছরের ২৯ এপ্রিল অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো: আমিরুজ্জামান অবসরে যাওয়ার পর ওই পদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছিলেন উপ-পরিচালক মুনশী মো. ছাদুল্লাহ। ওই পদে থেকে অধিদফতরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি যে কোটি কোটি টাকা তছরুপ করেছেন তার প্রমাণ উঠে এসেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি আবুল কালাম আজাদ বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। একইসঙ্গে আবারও নতুনভাবে পদায়নের মাধ্যমে দুর্নীতির পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মুনশী মো. ছাদুল্লাহদুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত, এ কারণেই তিনি অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বেশ পছন্দের।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো: আমিরুজ্জামান গত বছরের ২৯ এপ্রিলে অবসরে যাওয়ার পর ওই পদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছিলেন উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মুনশী মো. ছাদুল্লাহ। নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতরের যাবতীয় অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পন্ন করে থাকেন পরিচালক (প্রশাসন), সেই হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ওই দায়িত্ব পালনকালে অধিদফতরের ব্যাংকিং কার্যক্রমও পরিচালনা করেছেন মুনশী ছাদুল্লাহ। নতুন পরিচালক (প্রশাসন) পদে নিয়োগ পান ডা. শহিদ মো. সাদিকুল ইসলাম।

গত বছরের ৪ জুলাই তিনি এ দায়িত্বে যোগদান করেন। কিন্তু তার কাছে অধিদফতরের ব্যাংক হিসাব পরিচালনায় অনেক অসংগতি ধরা পড়ে। উপপরিচালক মুনশী ছাদুল্লাহ খুব বেশি দিন ব্যাংক হিসাব পরিচালনার দায়িত্ব পালন না করলেও নতুন পরিচালক তার কাছ থেকে হিসাব বুঝে নিতে গিয়েই নানা অসংগতি দেখতে পান। পরে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে তিনি দেখতে পান দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্যাংক হিসাব পরিচালনায় নানা অনিয়ম আর তহবিল তছরূপের মতো ঘটনা ঘটে আসছে। তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেও মুনশী ছাদুল্লাহ নিজের দায়ভার এড়াতে চেক বই, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র গোঁজামিলের মাধ্যমে নতুন পরিচালক (প্রশাসন) সাদিকুল ইসলামের কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা করেন। কিন্তু সাদিকুল ইসলাম এসব গোঁজামিলের কাগজপত্র গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

জানা গেছে, রূপালী ব্যাংক মহাখালী শাখার হিসাব নং (০৪৩০০২০০০২৩৯১) এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লেনদেন হয়ে থাকে। অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শহিদ মো: সাদিকুল ইসলাম গত বছরের ২২ আগস্ট চিঠি দিয়ে ওই হিসাবের কার্যক্রম (লেনদেন) সাময়িক স্থগিত করার জন্য ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে একটি চিঠি দেন। একই চিঠিতে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নামে পরিচালনা করা ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের তথ্য চান। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ আগস্ট অর্থাৎ ব্যাংকে চিঠি দেয়ার দিন পর্যন্ত লেনদেনের হিসাব বিবরণী চাওয়া হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই সময়ের লেনদেনের পুরো হিসাব স্বাস্থ্য অধিদফতরকে দিয়েছে।

লেনদেনের ওই হিসাব বিবরণী থেকে দেখা যায়, এই আট মাসের বেশি সময়ে অসংখ্যবার এই হিসাব নাম্বারে নগদ টাকা উত্তোলন, এমনকি কখনো কখনো নগদ জমাও দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১১ জুলাই চার বার নগদ টাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিবারই উত্তোলন করা হয় সমান পরিমাণ অর্থাৎ ১ লক্ষ ২৮ হাজার ২শ’ ৮২ টাকা করে। ১৪ জুলাই চার দফায় উত্তোলন করা হয় একই পরিমাণ করে অর্থ। ৪ জুলাই নগদ জমা দেয়া হয় ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬শ’ ৫০ টাকা।

আবার দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক মো: নাসিরউদ্দিনও দুই দফায় ওই একাউন্ট থেকে ৪২ লাখ টাকার বেশি উত্তোলন করেছেন। এরমধ্যে ১০ জুলাই, ২০১৯ ইং তারিখে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮শ’ ৫১ টাকা, পরের দিন অর্থাৎ ১১ জুলাই উত্তোলন করেন ৪০ লাখ ৮৫ হাজার ৩শ’ ৩৮ টাকা। এই টাকা তিনি কোন খাতে খরচ করেছেন, এর জবাব পরিচালক (প্রশাসন) সাদিকুল ইসলামকে দিতে পারেননি। অথচ এই টাকা উত্তোলনের সময় সাদিকুল ইসলামই পরিচালক (প্রশাসন) এর দায়িত্বে ছিলেন। তাকে না জানিয়ে কেন ওই টাকা উত্তোলন করা হলো এবং কোন খাতে খরচ করা হলো সেই জবাব হিসাবরক্ষক নাসিরউদ্দিন ও উপপরিচালক মুনশী ছাদুল্লাহ দিতে পারেননি।

উপপরিচালক ছাদুল্লাহর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি পরিচালককে (প্রশাসন) মৌখিকভাবে জানান, ওই টাকা নগদ উত্তোলন করে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু পরিচালক (প্রশাসন) এ সময়ে প্রশিক্ষণের জন্য নগদ কোন টাকা বরাদ্দের বিষয়টি অনুমোদন করেননি বলে জানান।

২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে টেলিটক এর মাধ্যমে আবেদন প্রক্রিয়া বাবদ বিভিন্ন সময় আয় হয় ৭ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ৫০ টাকা। টেলিটক চেকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে এসব টাকা প্রদান করে। এসব চেক অধিদফতরের ব্যাংক হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে জমাও দেয়া হয়েছে।

সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার নিয়ম অনুযায়ী, এই টাকা রাজস্ব আয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সরকারি কোষাগারে তা জমা হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর এই টাকার পুরোটা কোষাগারে জমা না দিয়ে বেশিরভাগ টাকাই রূপালী ব্যাংকে নিজস্ব একাউন্টে রেখে দেয় এবং খরচ করতে থাকে। জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এই টাকার মধ্যে জমা দেয়া হয়েছিল মাত্র ২ কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার চারশ’৫০ টাকা। অবশিষ্ট অর্থাৎ ৫ কোটি ৬ লাখ ২৩ হাজার ৬শ’ টাকা অধিদফতরের নিজস্ব একাউন্টে জমা রাখা হয়। সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব খাতের আয় হলে সেই অর্থ দ্রæততম সময়ে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ রকমের আয়ের অর্থ মাসের পর মাস, এমনকি প্রায় এক বছর ধরে অধিদফতরের ব্যাংক একাউন্টে রেখে দিয়েছে। এ থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ, তাও নগদ লেনদেনের মাধ্যমে। এখন এই টাকার কোনো হিসাব দিতে পারেনি।

নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) দায়িত্ব নিতে গিয়ে এই অনিয়ম ধরা পড়ে। এ সময় পরিচালক (প্রশাসন) এর দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক (প্রশাসন) মুনশী ছাদুল্লাহকে চিঠি দিয়ে ব্যাংক হিসাব পরিচালনায় অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে জবাব চান। কিন্তুমুনশী ছাদুল্লাহ এর সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। হিসাবরক্ষক নাসিরউদ্দিনও এ অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারেননি। ফলে এরপর পরিচালক (প্রশাসন) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চিঠি লেখেন। মন্ত্রণালয় এর প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে। সুত্র: শীর্ষ নিউজ