অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

কর্ণফুলীতে আসল কাজীর দেখা নেই, নকল কাজীদের দৌরাত্ম!

0
.

বিশেষ প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় বিয়ের নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রারের কাজী অফিস গুলোতে আসল কাজির দেখা মিলছে না। এতে পাঁচ ইউনিয়নে বিবাহ নিকাহ পড়াচ্ছেন কাজী পরিবর্তে কাজীর সহকারী বা নকল কাজীরা। যদিও নিকাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রার আইনে এ ধরনের কোন সুযোগ নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলার কিছু কিছু ইউনিয়নে গত ১৩ বছরেও আসল কাজীর চেহারা দেখেননি এলাকার লোকজন।

এরই ফাঁকে সহকারি কাজীদের দৌরাত্বে পুরো উপজেলায় বাল্যবিবাহ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। চলছে কাজি ব্যবসা রমরমা। অথচ বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসনের হাক-ডাক, হুমকি-ধমকি, জেল-জরিমানা আর নানান নির্দেশনা সত্ত্বেও সব কিছুই অকার্যকর হয়ে গেছে কিছু সহকারি কাজীদের অতিলোভী কৌশলী তৎপরতায়। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের মেয়ে শিক্ষার্থীরা সংসার ধর্ম বুঝে উঠার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হচ্ছে। উপজেলার সর্বত্র প্রকাশ্যে বা গোপনে বাল্যবিয়ের হিড়িক চললেও সংশ্লিষ্ট কাজীরা নিবন্ধনের কথা অস্বীকার করে চলেছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে কাজী অফিস গুলোতে কোন ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করার দৃশ্যও চোখে পড়েনি।

টানা ১০ দিনের অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া যায়, কাগজে কলমে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে কাজির দায়িত্বে শরফুদ্দীন মোঃ সেলিম। কিন্তু পুরাতন ব্রিজঘাটে কাজি অফিসে তার পরিবর্তীতে ১৩ বছর ধরে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিবন্ধনের কাজ করছেন মো. কামরুল ইসলাম নামে এক যুবক।

অন্যদিকে, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের কাজির দায়িত্বে আছেন সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলাম। অথচ সৈন্যেরটেক কমিউনিটি সেন্টার রোডস্থ কাজি অফিসে বিয়ে পড়ান মো. সরোওয়ার নামে এক যুবক, শিকলবাহা ইউনিয়নে কাজীর দায়িত্বে আছেন মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, কিন্তু তার পরিবর্তে কলেজ বাজার কাজী অফিসে কাজ করছেন মো. মফিজ, বড়উঠান ইউনিয়নের কাজি মুহাম্মদ আলমগীর আনছারী।,তার পরিবর্তে ফকিরনীরহাট ও জামতলা বাজারে নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার করেন মুহাম্মদ সালাউদ্দীন। একইভাবে কাগজে কলমে জুলধা ইউনিয়নের কাজীর দায়িত্বে আছেন মাওলানা এ.এইছ.এম এহছানুল্লাহ, কিন্তু তার পরিবর্তে ফকিরনীর হাটে বিয়ে পড়ান তারই সহকারি মোহাম্মদ সৈয়দ। এ যেন আসল বিয়ে পড়ান নকল কাজী! মাসের পর মাস বছরের পর বছর এরাই কাজী, এরাই সব।

অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, অভিভাবকরা স্বয়ং কাজীর সহকারি এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সহায়তায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক এসব মেয়েদের রেজিষ্ট্রেশন করে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল তদারকীর কারণে কাজিরা এসব অনিয়ম করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কখনো কখনো বয়সের প্রমাণপত্র হিসেবে জন্ম নিবন্ধন সনদ ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হলে কাবিন ছাড়াই মৌলভী ডেকে বাল্যবিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানাগেছে, কর্ণফুলীতে কাজিদের ইনকামের বড় একটি অংশেই আসে উপজেলার গার্মেন্টস শ্রমিকদের নয়-ছয় বিয়ের মাধ্যমে। যাদের অধিকাংশ বিয়েই হয় সহকারি কাজিদের কারিশমায়।

সূত্র জানায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীরাও জন্ম নিবন্ধনের কল্যাণে প্রাপ্ত বয়স্কের সনদ নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ছে। নিম্ন মাধ্যমিক কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একের পর এক বিয়ের ঘটনায় শিক্ষকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কাজীদের বড় অজুহাত তাঁরা চেয়ারম্যান কতৃক প্রদত্ত জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে বিয়ে পড়ান। জানতে চাওয়া হয় তাঁদের কাছ থেকে, জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র আসল না নকল সেটা এক্সেস করার কোন উপায় রয়েছে কিনা। কিন্তু কাজিদের সরাসরি উত্তর এ রকম ক্রস চেক করার কোন সুযোগ নেই। ফলে এ সুযোগে নকল কাগজে বিয়ে পড়ানোর সুযোগ লুপে নিচ্ছে প্রতারকরা।

এছাড়াও কর্ণফুলীতে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার নিবন্ধনের দায়িত্ব নিয়ে দুই কাজী শরফুদ্দীন মোঃ সেলিম ও সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলামের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও অসংগতিপূর্ণ বক্তব্যের কারণে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে পক্ষ বিপক্ষে এলাকায় নানা লিফলেট বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে সরকারি নিবন্ধনে বিয়ে পড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। এনিয়ে এলাকায়ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলার এনজিও ফোরামের সমন্বয়ক মো. ওসমান হোসাইন জানান, আইনি ঝামেলা এড়াতে কাজীরা বেশকিছু কৌশল নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক কাজী কাবিননামার দুটি বালাম সংরক্ষণ করে থাকেন। একটি আসল এবং অপরটি নকল বা বিকল্প। বাল্যবিয়ের তথ্য কাবিননামার বিকল্প বালামে লিপিবদ্ধ করা হয়। কোনো ঝামেলার আঁচ পেলে বালামটি গায়েব করে দেয়া হয়। কাবিননামার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক কাজি এক বা একাধিক সহকারী রাখেন।

তিনি আরো বলেন, সহকারীরা সরেজমিন গিয়ে বিয়ে পড়াতে মৌলভীর কাজ করেন। পাশাপাশি বিকল্প কাবিননামায় তথ্য লিখে আনেন। এমন বিয়ে পড়ানো বা কাবিননামা নিয়ে কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হলেও কাজিরা নিরাপদ থেকে যান। অপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ের বিয়ের আগে নানা অজুহাতে অভিভাবকরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেন। সনদের কল্যাণে যে কোনো বয়সের ছেলেমেয়ের বয়স রাতারাতি ১৯ বছরে উঠে যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান,“আইনের জটিলতার কারণে বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবা হয়নি। তবে দ্রুত এ বিষয়ে যাচাই বাচাই করে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা পাঠক ডট নিউজকে জানান, উপজেলা প্রশাসন সব সময় বাল্যবিয়ে রোধে প্রস্তুত। তবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের (কাজী) কারসাজিতে গোপনে অনেক বিয়ে হয়ে যায়। এসব নিকাহ রেজিস্ট্রারদের (কাজী) বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।’