অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

রাজনীতির শুদ্ধ সাধক ছিলেন জননেতা এ বি এম আবুল কাশেম

1
11754528_105744293107567_4227844158095818087_o
ড.মনওয়ার সাগর

The dear departed souls do not die indeed, Never do they part from us, though they be deceased –Iqbal,

14993317_1729044354025248_2531489968419152682_n
মরহুম এ বি এম আবুল কাশেম।

মৃত্যু মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি,পরিণাম নয়।মৃত্যুর পরেও যে মানুষকে জীবিত মানুষেরা দীর্ঘদিন স্মরণে রাখে, তাঁর জীবনের আদর্শকে অনুসরণের চেষ্টা করে সে মানুষই দেশে কালে সমাজে অমরত্ব লাভ করে,স্যার ছিলেন তেমন একজন সমৃদ্ধ মানুষ।আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, নিষ্ঠাবান একজন রাজনীতিকের নাম এ বি এম আবুল কাশেম। সীতাকুণ্ডের স্বর্ণভূমিতে জন্ম নেওয়া এ রাজনীতিক জীবন সায়াহ্নেও ছিলেন রাজনীতির কিংবদন্তি পুরুষ। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হন।স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তাঁর সদর্প বিচরণ আমাদের গর্বিত করে তোলে। রাজনীতির ফাঁকে ফাঁকে মানুষ গড়ার শিল্পী হিসেবে একজন সুবেদিত শিক্ষক, জাতি গঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি।

কাশেম স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই,এই পৃথিবী এবং সংসারের দূলি-ধূসরতা রৌদ্রকরোজ্জ্বল মায়াবী উঠোন থেকে অকস্মাৎ আলোহীন,অন্য এক জগতে, অন্য এক ভূবণে প্রবেশ করেছেন।আমরা কেউ জানিনা সে শাশ্বত গহবরটি কেমন, কী তার সীমানা, কী তার রং-রুপ,চিত্রকল্প।তা আমরা কেউ জানিনা।শুধু শোকার্ত চেতনায় অণুমান করি সে একটি মঙ্গললোক, সে একটি কল্যাণলোক।সেখানে যেতে হলে শোকের মধ্য দিয়ে এক অবিচ্ছিন্ন বিশ্বাসেই আমরা যাত্রা করি।আমাদের সে যাত্রা অনিবার্য, অলংঘনীয় এবং অপরিবর্তনীয়।

স্যার এর অনন্ত যাত্রার মুহুর্ত্বগুলো আমার জন্য অনেক বিষাদের, শোকের,বেদনা বিহবলতার।আমি যখন্ স্যারের মুখের দিকে,তাঁর অবয়বের দিকে ফিরে তাকাই সব বেদনা বিধূরতা, বিহবলতা ছাপিয়ে একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের প্রতিকৃ্তি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, প্রতিভাত হয়, দীপ্যমান হয়। আমি জানি যে ব্যক্তি একবার মৃত্যুর সহযাত্রী হয় সে অনন্তের অন্তহীন অন্ধকারে ভ্রাম্যমাণ।

দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল বলেছিলেন ‘Teachers are more than any other profession, guardians of civilization’ অর্থাৎ যে কোনো পেশার চাইতেও উপরে শিক্ষকেরা সভ্যতার অভিভাবক।সে জন্যই হয়তো স্যার প্রথম জীবনে শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন।শিক্ষকতা জীবনে আত্মোৎসর্গের একটাই উদ্দেশ্য ছিল যেন তাঁর ছাত্ররা আলোকিত মানুষ হয়ে দেশের কল্যাণে নিবেদিত হতে পারে।

কাশেম স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন,স্যার যখন কাট্টলী নূরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তখন আমার আব্বা (মোঃজিয়াউর রহমান) ছিলেন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমি ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত স্যারের ছাত্র ছিলাম।ভাল বিতার্কিক ছিলাম বলে স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন।পরবর্তিতে স্যারের হাতেই রাজনীতির দীক্ষা নিই।স্যার আমাদের অষ্টম শ্রেণীতে কিছুদিন বাংলা পড়াতেন, পাঠ কৌশলেই প্রকাশ পেতো তাঁর সাহিত্যবোধ ও সাহিত্যরুচি, অন্যদিকে তিনি ছাত্রাবস্থা থেকে যে-অঙ্গীকারের চেতনায় আন্দোলিত হয়ে রাজনীতির সৃজনভুবনে প্রবেশ করেছিলেন তা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে আমৃত্যু পালন করে গেছেন। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সমাজনির্মাণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ছাত্রদের সৃজন-উদ্যান ও চেতনায় নানাভাবে ছাপ ফেলেছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে ফুটে ওঠেছে মননের ঔজ্জ্বল্য ও দীপ্ততা। বক্তব্যে স্বাদু গদ্যের কুশলতা তাঁকে স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করেছে।

স্যার আমাদের বলতেন ‘মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিভাপন্ন দিক গুলোর সাথে পাঠশালার পূথিগত বিদ্যার কোন সম্পর্ক নাই।তবুও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যাতিত মানুষের নির্মিত কাঠামোর ভিতরে প্রবেশে করা একেবারেই অসম্ভব’।

স্যারের মানস গঠন যেমন শিক্ষার আলোয় দীপায়ন ছিল তেমনি এ অঞ্চলের নিসর্গ ও জীবন বৈভব তার মানস সত্ত্বাকে সংবেদনশীল ও উজ্জ্বীবিত রাখত।সীতাকুণ্ডের প্রান্তিক মানুষগুলোর সংগ্রামশীলতা স্যারের চেতনাজগতকে মানবিক ও মর্মন্তুদ করত।জীবনের এ বিচিত্র অনুসন্ধানে অর্থাৎ মানুষের সুখ-দুখ ভালোবাসা ও মমতার নিবিড় পর্যবেক্ষণ তাঁর জীবন দৃষ্টিতে এনেছে স্বাতন্ত্রদীপ্ত সচ্ছতা।

স্যার ছিলেন একজন পরিশীলিত, মার্জিত, আধুনিক, সংবেদনশীল, মানবিক, বিচক্ষণ ও পুরোমাত্রায় প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব। কথোপকোথনে তিনি যেমন বাকসংযমী তেমনি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ছিলেন সৌজন্যনিবিড় নাগরিক মানুষ। তিনি অনুভবী দ্রষ্টা ও প্রশান্তময় অন্তরঙ্গ মানুষ। স্যারের জীবনে মেধার সঙ্গে মিশেছিল মনন, বুদ্ধির সঙ্গে শালীনতা, আভিজাত্যের সঙ্গে অমায়িকতা। কেবল চলনে বলনে আধুনিকতা নয় মানব জীবনের সার্বিক আধুনিকতাকেই তিনি ধারণ করতে পেরেছিলেন। কখনো কখনো উন্মত্ত মনে হলেও মূলত তিনি বরং ঋজু ও সহনশীল।

স্যার ছিলেন আধুনিক সীতাকুণ্ডের রুপকার ও স্বপ্নদ্রষ্টা।মানুষের জন্য,দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন স্যারকে এতোটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলযে, এ পথের সমস্ত কষ্ট ও যন্ত্রণাকে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছেন,আত্মদানের মধ্য দিয়েই মহান পবিত্রতায় স্নাত হয়েছেন।

আমার আব্বা স্যার সম্পর্কে বলেন ‘তিনি ছিলেন আদর্শবান সৌন্দর্যপ্রিয়, মূল্যবোধসম্পন্ন,জ্ঞান-পিপাসু ও সপ্রতিভ মানুষ।পরিশ্রমের সহজাত ক্ষমতা,সতর্ক পরিকল্পনা,কর্ম প্রক্রিয়ায় দীপ্র নিয়ন্ত্রণ সবই ছিল তাঁর।এম আর সিদ্দিকীর পর সীতাকুণ্ডের আওয়ামীলীগের অস্তিত্বের ধারা অনেকেই টেনে টেনে বহন করেছেন ঠিকই, সর্ব শেষ এক জন কান্ডারী হয়ে সীতাকুণ্ড আওয়ামীলীগের হাল ধরলেন এ বি এম আবুল কাশেম,শুরুতে অসাধারন মমত্ব বোধ নিয়ে জনতার সাথে মিশে গেলেন।জনতাও তার উপযুক্ত সন্মান দিলেন, তাকে দু’বার এম পি নির্বাচিত করলেন,তাও আবার জনাব সাবেক মন্ত্রী এল কে সিদ্দিকীর মত পরিশীলিত,সৎ ও শক্তিমান রাজনীতিককে পরাজিত করে’।অধিকন্তু তিনি প্রতি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন।

এক জন মানুষের প্রতিদিনের সঠিক সিদ্বান্তই তার আগামীর পথ চলাকে মসৃন করে তোলে,কাশেম স্যারও ছিলেন তেমনি একজন মানুষ।অসাধারন ক্যারিসমেটিক ব্যাক্তিত্ব ,ধী- শক্তি সম্পুর্ন মানুষ, যিনি অনেক দিন রাজনীতিতে থাকার কথা ছিল কিন্তু বয়স তাকে আটকে দিল।আওয়ামীগ তাঁকে দেশ প্রেম, মানুষের প্রতি ভালেবাসা অসাম্প্রদায়ীক জীবন বোধ, মাথা নিছু না করা, সৎ ও সুন্দর জীবন উপহার দিয়েছে।জীবনে সফল হওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু নিজস্ব সিদ্ধান্ত থাকে, তাই কোনো বাঁধায় অবদমিত না হয়ে স্যার সারাজীবন নিজস্ব সিদ্ধান্তেই অটল থেকেছেন।

আমার আব্বা বলতেন- Man lives not in years, but in achievement কর্ম মানুষকে অমর করে রাখে মানুষের মাঝে।কাশেম স্যার যখন আব্বার সহকর্মী ছিলেন-তখন দু’জনেই হালিশহরের একজন পীর সাহেবের কাছ থেকে কিছু দীক্ষা পেয়েছিলেন,আব্বাকে দেখতাম তাহাজ্জত পড়তে,সারারাত জিকির করে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমোতে,কাশেম স্যারও খুব ধার্মিক ছিলেন।পার্থিব দৃষ্টি্তে রাজনীতি নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল অদৃশ্য অন্তর্যামীর খোজে চক্ষুষ্মান। নির্জনে জান্নাতী স্বপ্নে বিভোর সুপ্ত মনের তীব্র বাসনা থেকে তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করতেন।

স্যারের জীবনের মূল আকর্ষণ প্রভূ ভাবনা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাঁর জীবন-জীবিকা, চিন্তা-চেতনা ও সাধ্য-সাধনার স্রোতে মিশে ছিল স্রষ্টার নৈকট্য লাভের অনুভূতি । একান্ত নির্জন নিরালায় পার্থিব জীবনের ব্যস্ততা, দুঃখ তাপ, হাসি আনন্দকে দূরে ঠেলে দিলের মধ্যে গেঁথে রাখতেন শুধুমাত্র প্রভূ দর্শনের মোহমায়া। ভাবাবেগের অতল সমূদ্রে কিছুটা মুহূর্ত কাটালেই তার শীতল প্রাণ জানিয়ে দিতো সেই প্রাপ্তির অমূল্য স্বাদ! স্যারের মোহ, চিন্তা, সাধ, একাগ্রতা এবং সাধনা তখন স্রষ্টা প্রেমে এতটা প্রবল ছিল যে কেবল মালিকের কাছে তিনি প্রাণের সকল দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা উজাড় করে বলতেন। সে যে কী এক অভিভূত করা অনুভূতি অনুরাগী মাত্রই জানেন। এভাবে অনেক বছর কেটেছে এমনিভাবে গভীর নিমগ্নতায়। এটাই ছিল তাঁর সাধনাময় জগতের শান্তিপূর্ণ জীবন। মহান আল্লাহ স্যারকে জান্নাত দান করুন।

লেখক পরিচিতি: বিশিষ্ট কবি, লেখক ও সংগঠক

১ টি মন্তব্য
  1. Monowar Sagar বলেছেন

    ধন্যবাদ পাঠক নিউজ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শিল্পী ভাইকে সদয় হয়ে আমার এ লেখাটি ছাপাবার জন্য।