অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল: ৮ বছরে ডুবেছে ২০ জাহাজ

0
screenshot_16
.

বার বার নৌ দুর্ঘটনা এবং জাহাজ ডুবির কারণে অনেকটা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও বন্দর চ্যানেল। সর্বশেষ গতকাল বুধবার একদিনেই ডুবেছে চারটি লাইটার জাহাজ। এ অবস্থায় দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে বন্দর চ্যানেল দিয়ে বড় জাহাজ চলাচল।

এদিকে ৪টি লাইটারেজ জাহাজের সাথে সাগরের মিশে গেছে কয়েক কোটি টাকার পণ্য। এতে ব্যবসায়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছে দেশের অথনীতি। এসব জাহাজ ডুবির ঘটনায় অন্তত ৪০ জন মাঝিমালাকে উদ্ধার করা হলেও এখনো সাগরে নিখোঁজ রয়েছে ২ জন।

গতকাল ডুবে যাওয়া চারটি জাহাজের দুটি সন্দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরের ভাসানচর এলাকায়, একটি কর্ণফুলী নদীর মোহনায় এবং অন্যটি পতেঙ্গো সৈকতের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে। কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে ১ ও ৩ নম্বর বয়ার মাঝখানে ডুবে যাওয়া জাহাজটি বন্দর চ্যানেলে ডুবলে একেবারে বন্ধ হয়ে যেত বন্দরে জাহাজ চলাচল। চ্যানেলের বাইরে এ দুর্ঘটনা ঘটায় বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।

screenshot_19
.

চট্টগ্রাম বন্দরে ডুবে থাকা জাহাজের একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ৮ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল ও আশেপাশে এলাকাজুড়ে অন্তত ২০টি ছোট বড় জাহাজ ডুবে গেছে। মাত্র ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চ্যানেলে এখনও ডুবে আছে বেশ কয়েকটি জাহাজ, কোষ্টার ও ট্যাংকার। বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়ার একমাত্র পথে চলছে অনুমোদনহীন শতাধিক জাহাজ। অবৈধ এসব নৌযান একের পর এক চ্যানেলে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ এসব নৌযানের দাপট। কারণ অবৈধ এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বন্দরে ম্যাজিষ্ট্রেট থাকলেও তার ক্ষমতা নেই। আবার ১০৫ বছর আগে প্রণীত বন্দর আইনে নেই আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোন বিধান।

চলতি বছরের মার্চে এমভি সেন্টি ভ্যালিয়েন্ট জাহাজ থেকে এমভি খান সন্স-১ নামের একটি লাইটার জাহাজে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল জিপসাম স্থানান্তর করা হচ্ছিল। এ সময় কাছাকাছি থাকা এমভি গ্রেট সিনারি নামের আরেকটি বড় জাহাজ এসে ধাক্কা দেয় লাইটার জাহাজটিকে। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডুবে যায় সেটি। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ২০ আগস্ট ৬০০ টন সিমেন্ট নিয়ে ‘এমভি হ্যাংজাউ’ জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় শ্রীলংকার পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি ভাদুলি ভ্যালি’। এর পরের দিন একইভাবে ৬০০ টন সার নিয়ে বন্দরের বহির্নোঙরে ডুবে যায় লাইটার জাহাজ ‘এমভি হাবিবুর রহমান’। একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডুবে যায় সারবোঝাই কোস্টাল জাহাজ ‘এমভি বেঙ্গল ব্রিজ’। ২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি নিমজ্জিত জাহাজের ধাক্কায় ৯০০ টন গম নিয়ে ‘এমভি প্রিন্স অব মধুর খোলা-২’ এবং ২১ এপ্রিল ‘এমভি সেভেন সার্কেল-২’ জাহাজ ডুবে যায়।

screenshot_18
.

একই বছরের ৭ মে চ্যানেলের মাঝামাঝি জায়গায় ডুবে যায় সিমেন্টের ক্লিংকারবাহী ‘এমভি টিটু-৯’ নামের আরেকটি জাহাজ। ১১ জুলাই বন্দরের জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জিপসাম বহনকারী জাহাজ ‘এমভি মডার্ন’ ডুবে যায়। এভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি জাহাজ ডুবে গেছে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল সূত্র জানায়, সর্বশেষ বুধবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সন্দ্বীপ চ্যানেলের কাছে দারিন দারসাব নামের একটি লাইটার জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজটি দুই হাজার টনের মতো অপরিশোধিত চিনি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কুয়াশার কারণে জাহাজটি একটি চরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আংশিক ডুবে যায়। এর পর সকাল পৌনে ৭টার দিকে সন্দ্বীপ চ্যানেলে গ্লোরি অব শ্রীনগর-৪ নামের আরেকটি জাহাজ ডুবে যায়। দেড় হাজার টনের বেশি ভুট্টা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে অন্য একটি জাহাজের ধাক্কায় দুর্ঘটনায় পড়ে জাহাজটি। এমভি মজনু নামের একটি লাইটার জাহাজ বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে টিএসপি সার খালাসের সময় কাত হয়ে যায়। এতে লাইটার জাহাজটিতে পানি ঢুকতে শুরু করে। ওই অবস্থায় জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে আনার চেষ্টা করেন ক্রুরা। সকাল ৭টার দিকে পতেঙ্গার কাছাকাছি গিয়ে একটি চরে আটকে গিয়ে জাহাজটি আংশিক ডুবে যায়। এছাড়া ল্যাবস-১ নামে অন্য একটি জাহাজ ১ হাজার ৫০ টন সিমেন্টের ক্লিংকার নিয়ে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। কর্ণফুলীর মোহনায় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মোড় ঘোরানোর সময় কাত হয়ে ডুবে যায় এটি।

ship-down_38473
.

এসব দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম  বলেন, ‘আমাদের এরিয়ার মধ্যে ল্যাবস-১ নামের জাহাজটি ডুবেছে। বাকিগুলো আমাদের আয়ত্তের বাইরে। আমাদের চ্যানেল সুরক্ষিত আছে। জাহাজ মালিকদের উদ্ধারের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। ডুবে যাওয়া জাহাজ মালিকদের নিজ দায়িত্বে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।’

এদিকে একের পর এক পণ্যবাহী জাহাজডুবির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও চ্যানেলের মধ্যে যে হারে দুর্ঘটনা ও জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে তা অস্বাভাবিক। ডুবে থাকার ফলে জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতাসহ ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিমজ্জিত জাহাজ উদ্ধারে বন্দর ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা না থাকা এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও রয়েছে। ডুবে যাওয়া জাহাজগুলো উদ্ধারে দেশী-বিদেশী কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

জানা গেছে, চ্যানেলের মতো স্পর্শকাতর স্থান নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের এমন উদাসীনতা বাড়িয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ঝুঁকি। কারণ ডুবে যাওয়া এসব নৌ যান বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজ ঢুকতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আবার জাহাজের আশপাশে পলি জমে কমছে নদীর নাব্যতা। শিগগির জাহাজ ডুবির ঘটনা না কমলে ভবিষ্যতে বন্দর চ্যানেল বেশি গভীরতার জাহাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

images_17097_0
.

বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে বন্দর অচল হয়ে পড়ে। চ্যানেলের ঝুঁকি কমাতে দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আইন সংশোধন করতে হবে। অবৈধ নৌযান নিয়ে চ্যানেলকে যারা হুমকির মুখে ফেলছে তাদের ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে।

বন্দর চ্যানেলে এখনো ডুবে থাকা জাহাজের খতিয়ান থেকে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২০ আগষ্ট এমভি হ্যাংজাউ জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় শ্রীলংকার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি ভাদুলী ভ্যালী। একই দিন ৬০০ টন সার নিয়ে চ্যানেল সংলগ্ন বহির্নোঙরে ডুবে যায় লাইটারেজ জাহাজ এমভি হাবিবুর রহমান। ১২ সেপ্টেম্বর ডুবে যায় সার বোঝাই কোষ্টাল জাহাজ এমভি বেংগল ব্রিজ।

২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ৯০০ টন গম নিয়ে ডুবে যায় এমভি প্রিন্স অব মধুর খোলা-২ নামের জাহাজ। ২১ এপ্রিল ডুবে যায় এমভি সেভেন সার্কেল-২৫ নামের অপর একটি জাহাজ। ৭ মে সিমেন্ট ক্লিংকার নিয়ে ডুবে যায় এমভি টিটু-৯ নামের আরেকটি জাহাজ। ১১ জুলাই বন্দরের ড্রেজার খনকের সাথে ধাক্কা লেগে এক হাজার টন জিপসাম নিয়ে ডুবে যায় অভ্যন্তরীণ নৌযান এমভি মডার্ন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বন্দরের বহির্নোঙরে জিপসাম নিয়ে ডুবে যায় লাইটারেজ ‘এমভি চট্টগ্রাম’। গতকাল পর্যন্ত ওই জাহাজটি উদ্ধার করা যায়নি।

বন্দর চ্যানেল ও সংলগ্ন এলাকায় এর আগে ডুবে যাওয়া আরো জাহাজের মধ্যে আছে, এমভি সুরমা, এমভি কাদের, এমভি থেটিক, এমভি ফরচুন, এমভি বিশ্বকুসুম, এসবি ক্রিষ্টাল-৯, কোষ্টার সি-১০৬৩, এমভি ফিরোজ ফারজানা ও এমভি হ্যাংগ্যাঙসহ আরো কয়েকটি জাহাজ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বন্দর চ্যানেলে ডুবন্ত জাহাজ নানা সমস্যা তৈরি করলেও এসব উদ্ধারে বন্দর কর্তৃপক্ষের তেমন কোন উদ্যোগ নেই। ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারে স্যালভেস প্রতিষ্ঠানকে প্রচুর অর্থ দিতে হয় মালিকদের। এজন্য ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারে তেমন কোন তৎপরতা থাকে না। আইনী সীমাবদ্ধতার কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ মালিকদের এসব ডুবো জাহাজ উদ্ধারে বাধ্য করতে পারে না।