অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

বার্গার বিক্রেতা থেকে পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টের মালিক আবরার হোসাইন

3
ভ্যানগাড়িতে বার্গার বিক্রেতা থেকে ৫ তারকা রেস্টুরেন্টের মালিক আবরার হোসাইন।

লন্ডনের কুইন্সম্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। জীবনের প্রয়োজনে টাকা আয় করার জন্য চাকুরি খুঁজেননি। সুযোগ থাকলেও বড় শিল্পগ্রুপের হাল ধরেন নি। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজেই কিছু করার। হতে চেয়েছেন ব্যতিক্রমি উদাহারণ। তারুণ্যের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। কর্মজীবন অনেকটা শুরু করেছেন ফুটপাতে ভ্রাম্যমান ভ্যানগাড়িতে বার্গার বিক্রির মাধ্যমে। এখন তিনি চট্টগ্রামে প্রথম বিলাসবহুল পাঁচতারকা মানের বুটিক রেস্টুরেন্ট রিগালো’র মালিক।

তিনি চট্টগ্রামের তারুণ্যের আইকন আবরার হোসাইন। আবরার নিভৃতে থেকেই নিজের কাজটি করছেন। অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এই তরুন আড়ালে থাকতে পছন্দ করলেও তার ব্যতিক্রমধর্মী অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্টটিই এখন তাকে নিয়ন আলোয় নিয়ে এসেছে।

আবরার হোসাইন এবং ভিন্ন রকম স্বপ্নঃ
আবরার হোসেন জন্মেছিলেন অনেকটা সোনার চামচ মুখে নিয়েই। পারিবারিক উত্তরাধিকারে বড় শিল্পগ্রুপের মালিক আবারের পরিবার। তাদের একাধিক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার কর্মচারী কর্মকর্তা কাজ করেন।

শিল্পকলার সামনে আবরারের ভ্যানগাড়িতে বার্গার বিক্রির এই ভ্রাম্যমান দোকানের নাম দেন ‘বুম টাউন’।

আলাপকালে আবরার হোসাইন জানান, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিলেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সোনার থালায় বিলাসী খাবার খাবো এই চিন্তা কখনো কাজ করেনি। খুব ছোট বেলা থেকেই নিজেই কিছু করার স্বপ্ন ও চেষ্ঠা দুটোই একই সাথে কাজ করেছে। আমি লন্ডনে পড়ালেখা করি। লন্ডনের কুইন্সম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসি ২০১৩ সালে। দেশে ফিরে পারিবারিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের হাল ধরার কথা থাকলেও আমি নিজে কিছু করার চেষ্ঠা ও সপ্ন থেকে পিছু হটিনি। দেশে ফিরে শুধুমাত্র কাজ শেখার প্রয়োজনে ঢাকায় গ্রামীনফোনে ৭ মাস ইন্টার্ন কর্মী হিসেবে কাজ করি। এর পর ফিরে আসি চট্টগ্রামে। নিজ জন্মস্থানে ফিরেই নিজেই এককভাবে ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। লন্ডনে পড়লেখা করতে করতেই রেস্টুরেন্ট বা ভালো ফিউশন খাবারের বিজনেস টি আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো। নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত সেই চিন্তা থেকেই নিজের সঞ্চিত টাকা দিয়েই ভ্রাম্যমান ভ্যান গাড়িতে বার্গার বিক্রি শুরু করি। এই শুরুটা ২০১৪ সালের শেষের দিকে। আবরারের ভ্যানগাড়িতে বার্গার বিক্রির এই ভ্রাম্যমান দোকানের নাম দেন ‘বুম টাউন’। আবরার জানান, আমি প্রতিদিন বাসা থেকে ভ্যান টেনে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীর সামনে আসতাম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শিল্পকলার সামনে নিজেই বার্গার তৈরি করে বিক্রি করতাম। অল্পদিনের মধ্যেই আবরারের বুম টাউন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাত্র ৮ মাস ব্যবসা করেই রীতিমত নিজের পায়ে দাড়িয়ে যান আবরার হোসেন।

নগরীর দামপাড়ায় অবস্থিত রেস্টুরেন্ট রিগালো।

ফুটপাতের বুম টাউন থেকে বুটিক রেস্টুরেন্ট রিগালোঃ
আবরার হোসেনের গল্পটা ঠিক যেনো স্বপ্নের মতো। আবরার হোসাইন বলেন চট্টগ্রামে বড় কিছু, স্বপ্নের মতো আধুনিক ভিন্নধর্মী কিছু করার ইচ্ছেটা আমার রক্তের মধ্যেই ঢুকে গিয়েছিলো। আমি আমার স্বপ্ন থেকে পিছু হটিনি কখনো। বার্গার বিক্রি করতে করতেই শিল্পকলার কাছেই নগরীর দামপাড়া ওয়াসা মোড় এলাকায় রেস্টুরেন্ট করার মতো একটি জায়গা পেয়ে যাই। কিন্তু সবার মতো গতানুতিক খাবারের রেস্টুরেন্ট করার কথা আমার মাথায় আসেনি। আমি চিন্তা করেছি চট্টগ্রামবাসীকে নতুন কিছু দেখাতে। চট্টগ্রামে বসে আন্তর্জাতিক মানের খাবারের স্বাদ দিতে। সেই স্বপ্ন স্বাদ থেকেই ২০১৫ সালের শেষের দিকে ওয়াসার মোড়ে প্রথম অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিকমানের রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার কাজ শূরু করি। কয়েকজন বন্ধুর সহায়তা নিয়ে ‘রিগালো’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে। আবরার হোসেন জানান, ‘রিগালো’ একটি স্পেনিশ শব্দ। যার অর্থ উপহার। আমি চট্টগ্রামবাসীকে নতুন কিছু উপহার দিতেই রিগালো প্রতিষ্ঠা করি। ২০১৬ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামের প্রথম পাঁচ তারকা মানে ম্যাক্সিকান, আমেরিকান, চাইনিজ ফিউশন ফুডের ব্যতিক্রমী আয়োজন নিয়ে রিগালো আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এর আগে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত রিগালো’র নিয়োগকৃত কর্মীদের প্রশিক্ষন দেওয়া হয়।

সফল ব্যবসায়ি আবরার হোসাইন।

কেন ব্যতিক্রম ‘রিগালো’
রিগালোর স্বপ্নদ্রষ্ঠা আবরার হোসাইন জানান, চট্টগ্রামে রিগালো একমাত্র রেস্টুরেন্ট যে রেস্টুরেন্টের খাবারে প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক স্বাদ মিলবে। এখানে ম্যাক্সিকান খাবার তৈরির জন্য ম্যাক্সিকো থেকেই খাবারের উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। একইভাবে আমেরিকান এবং চাইনিজ খাবারের জন্য সেসব দেশ থেকেই খাবারের উপকরণ আমদানি করা হয়। এই রেস্টুরেন্টে যে শেফ খাবার তৈরি করেন তিনি বিদেশে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। এই রেস্টুরেন্টেই রয়েছে ফিউশন খাবারের আয়োজন। আবরার বলেন, আমরা এমনভাবে খাবার তৈরি করি একজন ভোজন রসিক মানুষ যখন আমেরিকায় বসে যে খাবার খেয়েছেন সেই একই খাবার রিগালোতে বসে খেলে কোন ভিন্নতা বুঝবেন না। এই রেস্টুরেন্টে আমেরিকান ফুড মানে প্রকৃতই আমেরিকান ফুড। রিগালো সময়ের সাথে আপডেটেড একটি রেস্টুরেন্ট। রিগালো শুধূ রেস্টুরেন্ট নয়- এটি আগামীদিনের ভালো মেমোরি তৈরির একটি ভালোবাসার কেন্দ্রও বলা যায়। এখানকার মুল বৈশিষ্ট আতিথেয়তা। কেউ এখানে খেতে এলে খাবারের ভিন্নধর্মী স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি একই দিনে মনে রাখার মতো ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে বাসায় ফিরে যেতে পারবেন। এই রেস্টুরেন্টে রয়েছে কফি’র আড্ডার জন্য ক্যান্টিনার জোন, ফ্যামেলি জোন, এবং পারসোনাল জোন। রিগালো একমাত্র রেস্টুরেন্ট যেটি প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে ক্লিনিংয়ের পাশাপাশি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রতি সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখা হয়। রিগালো চট্টগ্রামে একমাত্র রেস্টুরেন্ট যেখানে কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আপডেট রাখার পাশাপাশি প্রতিসপ্তাহে একদিন রেস্টুরেন্টের ম্যানু থেকে খাবার অর্ডার করে খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। রিগালোর ওয়াশরুম থেকে খাবার টেবিল চেয়ার, পরিবেশ, ইন্টেরিয়র সব কিছুই অন্যসব রেস্টুরেন্ট থেকে আলাদা ও বৈচিত্রপূর্ণ। কোন অতিথি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে এসে ওয়াশরুমে ব্যবহার করলে ওয়াশরুম থেকে ভালোলাগার মুগ্ধতার স্মৃতি নিয়ে ফিরতে পারবেন।

নিজ হাতে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন

রিগালো এবং আবরারের স্বপ্নযাত্রা
পাঠক ডট নিউজের সাথে একান্ত আলাপকালে আবরার হোসেন জানান, বার্গার বিক্রি থেকে শুরু করে আমি রিগালো প্রতিষ্ঠা করলেও আমি কখনো মালিক বা কর্তা সেজে বসে থাকি না। এই রেস্টুরেন্টের টেবিল পরিস্কার থেকে শুরু করে কিচেনে শেফকে সহায়তার কাজে অংশ নেই। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমি নিজেই অন্যান্যকর্মীদের সাথে রেস্টুরেন্টে কাজ করি। আবরার জানান, এই রেস্টুরেন্টে পেশাদার রেস্টুরেন্টকর্মীর পাশাপাশি কাজ করেন ভারত, নেপাল, ভিয়েতনামের কর্মী কাজ করেন। সব কর্মিই তাদের নির্ধারিত কাজের পাশাপাশি ক্লিনিং-এর কাজও করেন। আমি নিজেও রেস্টুরেন্ট মব করে পরিস্কার করি। এই রেস্টুরেন্টে সব কর্মীকেই সব কাজ করতে হয়।

আবরার বলেন আমি কর্মি হিসেবেই কাজ করতে করতেই এগিয়ে যেতে চাই। আমি যদি পড়ালেখা শেষ করে নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের হাল ধরতাম তাহলে আমার নিজের কিছু করা হতো না। আমি এখন প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। দেশি বিদেশী নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পেরেছি। বিদেশে পড়তে গিয়ে বাঙালী ছাত্র/ছাত্রীরা যেমন পার্টটাইম চাকুরি খুঁজেন একই ভাবে বাংলাদেশে বসে আমি বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের পার্টটাইম জব দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছি। এই সব প্রাপ্তি আমার কাছে আনন্দের। এই প্রাপ্তি আমার নিজের করে পাওয়া কিছু অন্যরকম ভালোবাসা।

স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান রেস্টুরেন্ট রিগালো।

এক নজরে আবরার হোসাইনঃ
আবরার হোসেন। বিজনেস এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন ইংল্যান্ডের কুইন্সম্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিতা মোহাম্মদ নুরুল আলম চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত এমইবি টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মা নেজাদ সুলতানা গৃহীনি। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আবরার হোসেন ব্যাক্তিগত জীবনে এখনো অবিবাহিত। স্বপ্ন দেখেন আবরার। স্বপ্ন বাস্তবায়নে যুদ্ধ করতে ভালোবাসেন। হতাশায় ডুবেননা কখনো। যে কোন বাধা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি খুঁজে নেন।

স্বপ্নের সেই ‘বুম টাউন’
আবরার হোসেন বুম টাউন থেকে শুরু করলেও সেই বুম টাউন ভ্যানটিকে ভুলে যাননি। আবরারের বুম টাউন এখন শিল্পকলার সামনেই স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বুম টাউন ক্যাফে’ নামে। শিল্পকলার জম্পেশ আডায় আবরারের বুম টাউন এখনো জমজমাট থাকে প্রতিদিন, প্রতিরাত। ভিন্নধর্মী নানা খাবার পরিবেশ করে দিন দিন আরও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বুম টাউন ক্যাফে।

আরকে/এসআইএস

৩ মন্তব্য
  1. Ayaar Muhammad বলেছেন

    কোন দেশে থাকে ও?

  2. Saiful Islam Shilpi বলেছেন

    এদেশেই আছেন..

  3. Mohammad Hasan Ullah বলেছেন

    Grt