অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

গ্রাম আদালতের বিচারিক ক্ষমতা প্রসঙ্গে : এ এম জিয়া হাবীব আহসান

0
.

২০০৬ সালের গ্রাম আদালত আইনের বিধান দ্বারা গ্রাম আদালতের বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয় ।এখানে সংক্ষেপে গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনস্বার্থে আলোচনা করা হলো।

গ্রাম আদালতের গঠন পদ্ধতি :-
একজন চেয়ারম্যান এবং উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুইজন করে মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হবে । প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুজন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হবে ।নাবালক এবং কোন নারীর স্বার্থ জড়িত থাকলে, সংশ্লিষ্ট পক্ষ সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে একজন নারীকে সদস্য হিসাবে মনোনয়ন প্রদান করবেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন, তবে যেক্ষেত্রে তিনি কোন কারণবশতঃ চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হন কিংবা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোন পক্ষ কর্তৃক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় সেক্ষেত্রে, মনোনিত সদস্য ব্যতীত উক্ত ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোন সদস্য গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন৷ বিবাদের কোন পক্ষে যদি একাধিক ব্যক্তি থাকেন, তবে চেয়ারম্যান উক্ত পক্ষভুক্ত ব্যক্তিগণকে তাদের পক্ষের জন্য দুজন সদস্য মনোনীত করতে আহ্বান জানাবেন এবং যদি তারা অনুরূপ মনোনয়নদানে ব্যর্থ হন তবে তিনি উক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে হতে যে কোন একজনকে সদস্য মনোনয়ন করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করবেন এবং তদানুযায়ী অনুরূপ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সদস্য মনোনয়ন করবেন৷ যে ইউনিয়নের মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হবে বা মামলার কারণ উদ্ভব হবে, সেই ইউনিয়নে গ্রাম আদালত গঠিত হবে; তবে পক্ষগণ ইচ্ছা করলে নিজ ইউনিয়ন হতে প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারবেন৷

গ্রাম আদালতের ক্ষমতাঃ-
গ্রাম আদালত তফসিলের প্রথম অংশে বর্ণিত অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে কেবলমাত্র অনধিক ৭৫ (পঁচাত্তর) হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করতে পারবে এবং তফসিলের দ্বিতীয় অংশে বর্ণিত বিষয়াবলীর সাথে সম্পর্কিত কোন মামলায় অনুরূপ বিষয়ে তফসিলে উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ প্রদানের জন্য আদেশ প্রদান করতে বা সম্পত্তির প্রকৃত মালিককে সম্পত্তি বা উহার দখল প্রত্যার্পণ করার জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবেন৷

গ্রাম আদালতে মিথ্যা মামলা দায়েরে দণ্ড প্রদানের এখতিয়ারঃ-
গ্রাম আদালত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করার আদেশ দিতে পারবে। এ আদালত কাউকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন না।

গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের বিধানঃ-
গ্রাম আদালত কোনো মামলায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিলে বা ৫ জনের মধ্যে অন্তত ৪ জন একমত হলে সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। আর ৩ জন একমত হয়ে ২ জন ভিন্নমত পোষণ করে সিদ্ধান্ত দিলে সে সিদ্ধান্ত ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে যে কোনো পক্ষ উক্ত সিদ্ধান্ত বাতিল, পরিবর্তন বা পুনঃবিচারের জন্য ফৌজদারী বিষয়ে প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বা দেওয়ানী বিষয়ে সহকারী জজ আদালতে আপিল করতে পারবেন।

গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পদ্ধতিঃ-
এ আদালত কাউকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বা সম্পত্তি বা দখল প্রত্যর্পণের আদেশ দিলে উক্ত আদেশ গ্রাম আদালতের জন্য নির্ধারিত ফরমে ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে আদেশ প্রদান করবেন এবং তা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবেন। ক্ষতিপূরণের অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদান করতে ব্যর্থ হলে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান (চেয়ারম্যান ভিন্ন ব্যক্তি হলে) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট বিষয়টি প্রেরণ করবেন । ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ -এর বিধান অনুসারে বকেয়া করের ন্যায় ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করবেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে প্রদান করবেন।

গ্রাম্য আদালতের সাক্ষী তলবের ক্ষমতাঃ-
আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য বা কোনো দলিল দাখিলের জন্য গ্রাম আদালত কোনো ব্যক্তিকে সমন দিতে পারবেন। সমন পেয়েও কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের আদেশ অমান্য করলে আদালত তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে অনধিক ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন।

গ্রাম আদালতে মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমাঃ-
গ্রাম আদালত গঠন হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। উক্ত সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে, গ্রাম আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করবেন। অন্যথায় মেয়াদ শেষে গ্রাম আদালত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেঙ্গে যাবে।

গ্রাম আদালতকে অবমাননার শাস্তিঃ-
গ্রাম আদালতকে অবমাননা করলে, আদালতের প্রশ্নের জবাব না দিলে, কোন দলিল দাখিল না করলে, আদালতের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে, সত্য না বললে আদালত ঐরূপ ব্যক্তিকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন । গ্রাম আদালত কাউকে জেল দিতে পারে না ।

গ্রাম আদালতে এডভোকেট নিয়োগ প্রসঙ্গেঃ-
গ্রাম আদালতে এডভোকেট নিয়োগ করা যাবে না । গ্রাম আদালতের বিচার কার্যক্রমের কোনো পর্যায়ে কোনো আইনবিদ/এডভোকেট উপস্থিত থাকতে বা কোনো পক্ষ সমর্থন করে কোনো বক্তব্য রাখতে পারবেন না।

গ্রাম আদালতের মামলা হস্তান্তর বা নথি তলবের ক্ষমতাঃ-
জনস্বার্থে বা ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন মনে করলে সংশ্লিষ্ট জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গ্রাম আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলা (তফশিলের ১ম ভাগের) প্রত্যাহার করে নিয়ে সেটি ফৌজদারি আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করতে পারেন। তাছাড়া গ্রাম আদালত যদি মনে করেন যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আসামির জরিমানা নয়, শাস্তি হওয়া প্রয়োজন তবে গ্রাম আদালত মামলাটি ফৌজদারি আদালতে প্রেরণ করতে পারবেন ।এছাড়াও মামলার কোন পক্ষ যদি চান ফোজদারী কার্যবিধির ৫২৮ ধারা মোতাবেক কোন ফৌজদারি মামলা বা দেওয়ানী কার্যবিধির ২৪ ধারা মোতাবেক কোন দেওয়ানী মামলা হস্তান্তর বা নথি তলবের জন্য যথাযথ ফৌজদারি বা দেওয়ানী আদালতে আবেদন করতে পারবেন ।

প্রশ্ন : গ্রাম আদালতে বিচার্য দেওয়ানী বিরোধ ও ফৌজদারি অপরাধসমূহ কি কি?
গ্রাম আদালতে বিচার্য ফৌজদারি অপরাধের ধারাসমূহ (তফশিলের ১ম ভাগ) : দণ্ডবিধি ১৪১, ১৪৩, ১৪৭, ১৬০, ৩২৩, ৩৩৪, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫২, ৩৫৮, ৪২৬, ৪৪৭, ৫০৪, ৫০৬, ৫০৮, ৫০৯ এবং ৫১০ ধারা। শুধু গবাদিপশু (যার মুল্য অনধিক ৭৫,০০০ টাকা) চুরির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৯, ৩৮০ এবং ৩৮১ ধারা। গবাদিপশু ব্যতীত অন্য চুরির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি ৩৭৯, ৩৮০ এবং ৩৮১ ধারা চোরাই মালের মূল্য যখন ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত। দণ্ডবিধি ৪০৩, ৪০৬, ৪১৭, ৪২০, ৪২৭, ৪২৮ এবং ৪২৯ ধারা- ক্ষতির পরিমাণ যখন ৭৫,০০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া গবাদিপশু অনধিকার প্রবেশ আইন-১৮৭১ এর ২৪, ২৬ এবং ২৭ ধারার অপরাধের বিচার গ্রাম আদালতে অনুষ্ঠিত হবে। দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে দাবীকৃত অর্থের পরিমাণ বা অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য বা অপরাধ সংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পত্তির মূল্য অনধিক ৭৫,০০০ টাকা হয়।

সালিশ বিচারের নামে অলিখিত স্ট্যাম্পে, কার্টেজ বা সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া ফৌজদারী অপরাধঃ-
আমাদের দেশে দেখা যায় সালিশ বিচারের কোন কোন ক্ষেত্রে অলিখিত নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প, কার্টেজ, সাদা বা নীলা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে পরবর্তীতে তাকে মূল্যবান দলিলে বা চুক্তিতে পরিণত করা হয় । গ্রাম আদালতের বিচার পদ্ধতিতে নানা ধরণের অনিয়ম, জোর-জবরদস্তী ও নানা অবাঞ্চিত কার্যক্রম দেখা যায় । বিশেষ করে সালিশের নামে নানা অনিয়ম নিত্যদিনের ঘটনা ।সালিশ বিচারের নামে অলিখিত স্ট্যাম্পে কারো স্বাক্ষর নেয়া ফৌজদারী অপরাধ ,এধরনের জঘন্য অপরাধ বন্ধ হওয়া দরকার। শালিশ বিচারের নামে কোন নাগরিককে আটক, শাস্তি প্রদান করা যায় না। আইন সম্মতভাবে গঠিত আদালত ব্যাতিত অন্য কারো সাজা প্রদানের অধিকার নেই। অনুরূপভাবে কারাদন্ডে দন্ডিত ব্যাক্তিকে কারাগার ব্যাতিত অন্য কোথাও আটক রাখার বিধান নেই। এটা বেআইনি আটক ও নির্যাতনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শালিশের নামে জামানতের টাকা জমা নেয়া, অলিখিত স্টাম্প,কার্টিজ কিংবা সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ার কোন বিধান আইনে নেই। অপরদিকে শালিসি আইন ২০০১ এর বিধান মতে শালিশী ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে যার সিদ্ধান্তের মর্যাদা আদালতের নির্দেশনার মতোই। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, শালিশী আইন সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরা সুন্দর শালিশী কার্যক্রম কে সর্বনাশ করে দিচ্ছে। তারা মেডিয়েশন ও আরবিট্রেশন এর সূক্ষ্ম পার্থক্যও জানে না। সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ ও আইন লংঘনকারীদের বিরূদ্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই জন্য সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের উপযুক্ত প্রশিক্ষন প্রদান করা জরুরী । বাংলাদেশের ৮৭,১৯১ টি গ্রামের ৪,৫৭১টি ইউনিয়নে কমপক্ষে একজন করে অন্ততঃ জুনিয়র এডভোকেটকে আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে এসকল আইনের ত্রুটি ও অনিয়ম দূর হবে । তালাক কার্যক্রম নিষ্পত্তিতে সিটি কর্পোরেশনে মেয়রের পক্ষে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেন । অনুরূপ গ্রাম আদালতেও একজন এডভোকেট আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

লেখকঃ  আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সু-শাসন কর্মী

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।