অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

‘আমার ছেলেকে ইফতার করতে দিলো না পাষণ্ডরা’

0
.

কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোর্শেদকে পৈশাচিকতায় হত্যা করা হয় সেই ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তের দাগ ছুঁয়ে বিলাপ করছিলেন মোরশেদের মা হালিমা খাতুন (৬৫)। কেঁদে কেঁদে তিনি বলছিলেন, ‘সারাদিন রোজা রাখা আমার আদরের ছেলেটাকে ইফতার করতে দিলো না পাষণ্ডরা। ঘাতকরা আল্লাহর দোহাইও মানলো না। আল্লাহ, আমার সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা এই নরপিশাচদের বিচার তুমি দুনিয়াতে-ই দেখাও। এ নির্মমতা যেন আর কোনো মাকে দেখতে না হয়, খোদা।’

চেরাংঘর বাজারে সন্তানের রক্তের দাগের পাশে মায়ের এ আহাজারি বাজারে উপস্থিত সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে। প্রতিবেশি, বাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা ও আত্মীয়স্বজনেরা তাকে বারবার শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মা হালিমার কান্না যেন থামছিলই না।

ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার (৮ এপ্রিল) আছর নামাজের পর মোরশেদের জানাজা শেষে বাড়ির সামনে মসজিদের দক্ষিণ পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজার শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন, শুভার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাও।

আইনী প্রক্রিয়া শেষে শুক্রবার দুপুরে মোরশেদের লাশ পিএমখালীর মাইজপাড়া গ্রামের বাড়িতে আনা হলে স্ত্রী নাসরিন সুলতানা রেখা, মেয়ে স্বপ্নমনি (১০), মরিয়ম (৭), ছেলে সুজন (৫)সহ স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে চারপাশ। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। মেয়েগুলো নিথর বাবাকে ছুঁয়ে কান্না করছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিল্ডিং ভাঙার কাজে ব্যবহৃত বিশালাকার হাতুড়ি দিয়ে প্রথম আঘাতে মাটিতে পড়ে যান মোরশেদ। ঘটনার আকস্মিকতা উপলব্ধি করতে পেরে হামলাকারীদের বলছিল- ‘আমি রোজায় বেশি ক্লান্ত, ইফতারের সুযোগ দাও, মারতে চাইলে ইফতারের পর মারিও।’

কিন্তু রোজাদার বলার আকুতিও তাদের দমাতে পারেনি। শেষ রক্ষা হয়নি প্রয়াত শিক্ষক ওমর আলীর ছেলে মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদের।

হত্যা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাবাজার এলাকার আলী আহমদ কোম্পানি জানান, বাজার করতে চেরাংঘর বাজারে পৌছার একটু পরে শোরগোল শুনতে পান। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গেলে পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন হাজারিকে বলতে শোনা যায়, ‘উপরের নির্দেশে তারে (মোরশেদ) মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবে না। যারা আসবে তাদেরও অবস্থা খারাপ হবে।’

এসময় আবদুল মালেকসহ ১৫-২০জন সন্ত্রাসী মোরশেদকে বরফ ধোলাইয়ের মতো প্রহার ও কোপাচ্ছিল। সবাইকে তদারকি করছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল। এলোপাতাড়ি মারধর ও কোপানোর ফলে মোরশেদ একটু নিস্তেজ হয়ে গেলে কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলি বর্ষণ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে হামলাকারীরা।

জানাজা ও দাফন শেষে ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ান আলাল-মালেকের বিশাল এক সিন্ডিকেট। তারা পাহাড় কাটা, বন দখল, জমি দখল, বিচারের নামে প্রহসন, চাঁদাবাজি, ইয়াবা বেচাকেনাসহ নানা অপরাধ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরাে ইউনিয়ন জুড়েই তাদের রাজত্ব। ভারী অস্ত্র থাকায় ভয়ে মুখ খোলে না কেউ। প্রতিবাদ করলেই মোরশেদ বলীর মতো জীবন দিতে হবে। ইউনিয়ন জুড়ে কেউ জমি ক্রয়- বিক্রয় বা দালান করলে তাদের চাঁদা দিতে হয়। তা না হলে সিন্ডিকেটটি কোনো কাজই করতে দেয় না। প্রশাসন নিরবে তদন্ত করলে এমন সব অসংখ্য অভিযোগের সত্যতা পাবে।

তারা আরও জানায়, মোরশেদ হত্যায় অংশ নেওয়া আবদুল মালেক, তাহের, মতিউল ইসলাম মতি, সিরাজুল মোস্তফা আলালসহ বেশ কয়েকজন একাধিক মামলার দাগি আসামি। এর মধ্যে আবদুল মালেক ও মতি সদ্য জেল ফেরত বলে উল্লেখ করেন তারা।

এ হত্যাকাণ্ডে পিএমখালী ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেকের নাম আসলেও তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। কিন্তু জানাজা পূর্ব বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগ করার কোনো সুযোগ নেই, এটি দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ। এ দলে ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজ, হুকুম দখল-খারাপ মানুষের জায়গা নেই।

শোকাহত হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মোরশেদকে ‌‘শহিদ’ উল্লেখ করে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের কেউ হতে পারে না। পার্টিতে যদি এদের কারো নাম থেকেও থাকে সমস্ত নাম এই মুহুর্ত থেকে বাদ হয়ে গেছে।’

ঘটনায় জড়িতদের ধরতে সিসিটিভির ফুটেজ, মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য প্রশাসন গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে তদন্ত করছে বলে উল্লেখ করেছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম। ইতোমধ্যে তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে শুক্রবার রাতে জানান তিনি। তখনও মামলা নথিভুক্ত হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) আছর নামাজের সময় ইফতার অনুষঙ্গ কিনতে চেরাংঘর বাজারে আসেন মোরশেদ আলী। তখনই সেখানে আগে থেকে উৎপেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পৈশাচিকতা চালায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ৮টার দিকে আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়। সৌদি প্রবাসী মোরশেদ বেড়াতে দেশে এসেছিলেন। তিনি এলাকায় ‘অন্যায়ের প্রতিবাদকারী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দেশে ঘুরতে আসলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলীখেলায় শখের বসে অংশগ্রহণ করতেন বলে তাকে মোরশেদ বলী নামে ডাকা হতো।