অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

আজ গণহত্যা দিবস: ২৯ বছরেও বিচার হয়নি খুনিদের

0
.

আজ ঐতিহাসিক ২৪ জানুয়ারী। রক্তস্নাত চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস। ১৯৮৮ সালের এই দিনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা নগরীর লালদীঘি ময়দানে জনসভায় যোগ দিতে গেলে বিনা উস্কানীতে তৎকালিন স্বৈরাচার এরশাদের পেটুয়া বাহিনী (পুলিশ) জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করে। আহত হয় শত শত মানুষ। সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।

জানা যায়, শেখ হাসিনার উপর গুলি করার সময় এক পুলিশ রাইফেলের কানেকশন বেল্ট খুলে ফেলায় তিনি বেঁচে যান। এসময় আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে আইনজীবী সমিতি অফিসে নিয়ে রক্ষা করেন।

.

নৃশংস এ ঘটনার ২৯ বছর পূর্ণ হলেও এখনও বিচার পাননি নিহতদের স্বজনরা। আদালতে ঝুলে আছে মামলার বিচার কাজ।
সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে আদালত ভবনের প্রধান গেটে নির্মিত ছোট্ট স্মৃতিস্তম্ভে প্রতি বছর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।

১৯৯৬ সালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি কর্মকর্তা কাদের খান আদালতে অভিযোগ পত্র (চার্জশিট) দাখিল করার পর ২০০০ সালের মে মাসে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন (চার্জ ফ্রেম) করা হয়। ১৬৮ জনের মধ্যে ৪১ জন সাক্ষী ইতিমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর ৭ বছর যাবত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় বা রাষ্টপক্ষ সাক্ষীদের হাজির করতে না পারায় মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। জানাগেছে ৭ বছরে মাত্র একজন সাক্ষি সাক্ষ দিয়েছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে গত এক বছরে ৭ জনের স্বাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।

মামলায় সাক্ষীদের হাজির না করা প্রসঙ্গে এই আদালতের সাবেক বিচারক গোলাম সরওয়ার এক আদেশে বলেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আদালতে সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব সংশিষ্ট পুলিশের। এরই মধ্যে মারা গেছেন মামলার বাদি শহীদুল হুদাও।

.

এদিকে চট্টগ্রাম গণহত্যায় নিহত শহীদদের স্মরণে নগরীর কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাদদেশে নির্মাণ করা হয়েছিল স্মৃতিফলক। স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভটি অবস্থা এখন শোচনীয়। অযত্ম অবহেলায় পড়ে রয়েছে স্মৃতিফলকটি। মুছে যাচ্ছে শহীদদের নাম। কোনো ধরনের সংস্কার কাজ হয় না এটির। বছরের একটি দিন শহীদদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানালেও বাকি সময় আর কেউ খবর রাখে না তাদের। প্রতিবছর গণহত্যা দিবসে স্মৃতিস্তম্ভটির উন্নয়নের জন্য এবং একটি পুর্ণাঙ্গ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করার দাবি জানানো
হলেও তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে তৎকালীন ১৫ দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর ও জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলিতে সেদিন শেখ হাসিনা ও কেন্দ্রীয় নেতারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান ২৪ জন ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। আহত হয় আরো প্রায় তিন শতাধিক। নৃশংসতার এক পর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহত অধিকাংশদের রাতের অন্ধকারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অন্যদিকে চলে লাশ গুম করার চেষ্টা। এই ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতোয়ালি জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ইতিহাসে দিনটিকে চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

.

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডির চার্জশিটভুক্ত আট আসামি হলেন- সাবেক সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কোতয়ালি থানার সাবেক টহল পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল এবং ৬ কনস্টেবল প্রদীপ বড়ুয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন, শাহ আবদুল্লাহ, আবদুস সালাম এবং বশির উদ্দিন। এদের মধ্যে গোবিন্দ চন্দ্র ঘটনার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। আর প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ এবং মির্জা রকিবুল হুদা ২০০৩ সাল থেকে জামিনে রয়েছেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে বশির উদ্দিন ও আবদুস সালাম জামিনে থাকা অবস্থায় মারা যান। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা এবং সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আবদুল কাদেরও মারা গেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলী এডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন বলেন, সাক্ষীরা হাজির না হওয়া, পুলিশের গাফলতি এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদাসীনতায় ২০০৯ সালের ১০ আগস্টের পর গত সাড়ে সাত বছরে কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। আগামী ৩১ জানুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। সেদিনের গণহত্যায় নিহতের আত্মীয়স্বজন ও সাংবাদিকসহ মোট ৯ জনকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরীসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিও রয়েছেন বলে আদালত সুত্রে জানাগেছে।

.

১৬৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ইতোমধ্যে ৪১ জন এ পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন, সেই ঘটনায় নিহত অজিত সরকারের স্ত্রী শেফালী সরকার, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে আশা করছি আর দুয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করার পর মামলার অগ্রগতি হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রধান ফটকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। গণহত্যায় নিহত সেই ২৪ জন হলেন- মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সীতাকুণ্ড থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম, ছাত্রনেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এথেলবাট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, হোটেল শ্রমিক ডি কে চৌধুরী, ছাত্রনেতা সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মোহাম্মদ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ এবং শাহাদাত।

.

২৪ জানুয়ারি গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী নগর আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে এমন একটি আলোচিত মামলা ঝুলে থাকা কোনমতেই কাম্য নয়। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ গণহত্যার বিচার না হওয়া মনে কষ্ট রয়ে গেছে। শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতিফলকটিও রয়েছে অযত্ম অবহেলায়। অথচ একটু উদ্যোগ নিলে গণপূর্ত অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন বা সিটি কর্পোরেশন এ স্মৃতিফলকটি সংস্কার করতে পারে। চট্টগ্রামের এ গণহত্যা সারাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে আরো জোরদার করে। গণতন্ত্রের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রামের এ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গণহত্যার নিহত স্বপন চৌধুরীর নিকটাত্মীয় আইনজীবী শিবুচন্দ্র মজুমদার বলেন, কেবল ২৪ জানুয়ারি এলে সবাই গণহত্যার শহীদ পরিবারের খোঁজ করেন। নতুবা সারাবছর কেউ খবরও নেয় না। কি রকম নিগৃহীত জীবনযাপন করছে ওরা তা বলাবাহুল্য। আমরা চাই সরকার আসামিদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসুক।