অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬: শ্বাসরুদ্ধকর ২০ ঘন্টার অভিযানে যা ঘটেছে

0
সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন ডিঅাইজি সফিকুল ইসলাম।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শ্বাসরুদ্ধকর ২০ ঘন্টার অভিযানের পর সমাপ্ত হল অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬। বুধবার বিকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা পর্যন্ত একটানা অভিযানে এক শিশুসহ চার জঙ্গি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সফলভাবে সমাপ্ত হয় এ অভিযানের।

অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় অবরুদ্ধ থাকা ৯০ বছরের বৃদ্ধসহ ২১ বাসিন্দাকে। ভবনটি থেকে নিস্ক্রিয় করা হয় প্রায় ১০টিরও বেশী শক্তিশালী বোমা। আটক করা হয় দুই জঙ্গিকে। এ ঘটনায় দুই সোয়াত সদস্যসহ আহত হন অপর এক পুলিশ।

.

জঙ্গি আস্তানা থেকে বোমা তৈরির এক্সক্লুসিভ সরঞ্জাম, একটি কার্টনে এসিড, লিকুইড কেমিক্যাল ও ১২ সেট জেল এক্সক্লুসিভ পাওয়া গেছে।

বুধবার দুপুরে সীতাকুন্ড পৌরসভার লামারবাজার আমিরাবাদের সাধন কুটির থেকে জঙ্গি দম্পতি জসিম ও আর্জিনাকে তাদের এক শিশুসন্তান সহ আটক করা হয়।

তদের দেয়া তথ্যমতে আরেকটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাবার পর বুধবার বিকেল তিনটায় সীতাকুণ্ডের কলেজ রোডের চৌধুরীপাড়ার প্রেমতলা এলাকার ছায়ানীড় ভবনে অভিযান শুরু করে পুলিশ, সোয়াত ও র‌্যাবসহ কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

.

ভোর ৬ টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চলে পুলিশ এবং জঙ্গিদের মধ্যে গ্রেনেড বিস্ফোরণ, গুলি বিনিময়। এক পর্যায়ে সোয়াত সদস্যরা পাশের একটি ভবন টপকিয়ে ছায়া নীড়ের ছাদ দিয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় জঙ্গিরা সোয়াত সদস্যদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। এতে দুই সোয়াত সদস্যসহ এক পুলিশ গুরুতর আহত হয়। তাদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

অভিযানের একসময় পরাস্ত হয় জঙ্গিরা, উপায়ন্তর না দেখে নিজেদের আত্মঘাতি বোমায় জীবন দেয় এক নারী সহ চার জঙ্গি। এর আগে বুধবার বিকালে ছায়ানীড় ভবনের নিচতলায় এ আস্তানায় পুলিশ অভিযান চালাতে গেলে ভেতর থেকে তিনটি হাতবোমা ছোঁড়ে জঙ্গিরা। এতে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেলসহ দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।

.

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, এটা ছিল আমাদের জন্য একটা দুঃসাহসিক অভিযান। নিজেদের নিরাপদে রেখে ও জিম্মিদের নিরাপত্তা বজায় রেখে অভিযান চালানো ছিল একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ। ভবনের ভেতরে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ছিল, রোগাক্রান্ত মানুষ ছিল। জিম্মিদের যেন কোন ক্ষতি না হয় সেটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সবদিক ঠিক রেখে সফলভাবে আমরা অভিযান সম্পন্ন করেছি।

দুটি জঙ্গি আস্তানা ‘নব্য জেএমবি’র মন্তব্য করে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, তাদের লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের ওপর হামলা করে মিরসরাই-সীতাকুন্ড অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা।

তিনি বলেন আমরা নিশ্চিত এরা নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্র সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বড় ধরনের নাশকতার লক্ষ্যে প্রচুর গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ করেছিল আস্তানায়।

.

তিনি বলেন, গত রাত থেকে ছায়ানীড় ভবনে বার বার অভিযান চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভেতর থেকে জঙ্গিদের প্রতিরোধের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সোয়াতের একটি টিম পাশের আরেকটি ভবনের ছাদে উঠে ছায়ানীড় ভবনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে। তা দেখতে পেয়ে দুই জঙ্গি ছায়ানীড়ের ছাদের ওপর উঠে সোয়াত টিমকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোঁড়ার চেষ্টা করে। ছায়ানীড় ভবনের জঙ্গি আস্তানা থেকে এখানে যেসব সরঞ্জাম পাওয়া গেছে সেগুলো দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ কেজি বোমা বানানো যেত বলে দাবী করেছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এডিসি কাজী সানোয়ার আহমেদ ।

তিনি বলেন, ছায়ানীড় ভবনের এই জঙ্গি আস্তানায় বোমা বানাতে দক্ষ দুজন বোমারু ছিলেন বলে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। সোয়াত টিমের সদস্যরা যখন পাশের আরেকটি ভবনের ছাদে উঠে ছায়ানীড় ভবনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে তখন জঙ্গিরা সোয়াত টিমকে লক্ষ্য করে ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

‘আত্মঘাতী জঙ্গিদের আত্মহননের ক্ষেত্রে এত শক্তিশালী বোমার ব্যবহার অতীতে বাংলাদেশে ঘটেনি। ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের যে বোমার বিস্ফোরণ তারা ঘটিয়েছে এটা যদি কোন জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণ করা হতো, তাহলে ৫০ গজের মধ্যে থাকা সবাই মারা যেত। এ সীমানার বাইরে থাকা বাকিরা গুরুতর আহত হতো। ’

.

এদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বিতল ভবনটিকে প্রতি ফ্লোরে চারটি করে মোট আটটি ও পাশের একটিসহ মোট ৯টি পরিবার বাস করতো। এর মধ্যে একটি ফ্ল্যাট জঙ্গিরা ভাড়া নিয়েছিল। বাকি ৮টি পরিবার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরুর পর ভবনে আটকা পড়ে। তাদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল কাজ করেছে। জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হওয়া সবাইকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।

এদিকে রাতভর অভিযানকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে প্রেমতলাসহ আশপাশের এলাকার পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষদের মাঝে আতংক বিরাজ করে। স্কুল-কলেজ সহ অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ দেখা গেছে।