অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

একটি চিংড়ি পোনা সংগ্রহকালে ধ্বংস হচ্ছে ৯৬টি অন্য মাছের পোনা!

0

সাইফুল ইসলাম শিল্পী/পূজন সেনঃ

.

বঙ্গোপসাগরের মোহনা এবং কর্ণফুলী নদীতে ত্রিকোণাকৃত্রির টেলা জাল (মশারি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি টেঁইয়া জাল) দিয়ে অবৈধভাবে চিংড়ি পোনা আহরণ করা হয়। পোনা আহরণ চলে বছরের চৈত্র থেকে আশ্বিন মাস। এসব পোনা পাঠানো হয় খুলনায়।

আর অপরিকল্পিত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি পোনা সংগ্রহের কারণে অন্য প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। এতে করে সাগরে দিন দিন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্ত হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

.

গবেষণায় উঠে এসেছে পরিবেশগত বিপর্যয় অবৈধ চিংড়ি পোনা সংগ্রহ এবং নানা কারণে ২৪ বছরের ব্যবধানে কর্ণফুলী নদী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অন্তত ২২ প্রজাতির মাছ্।

মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে একটি চিংড়ির পোনা ধরতে গিয়ে অন্য প্রজাতির মাছের ৩০ থেকে ৯৬ পোনা  (ক্ষেত্র ভেদে) ধ্বংস করে ফেলা হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন ধরা হচ্ছে লাখ লাখ পোনা। আর এ কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি অন্য মাছের প্রজনন নষ্ট হচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতিক ক্ষতি ছাড়াও সাগরে মৎস্য ভাণ্ডার শূন্য হওয়ার পথে।

.

এসব গলদা জাতের চিংড়ি পোনা দেশের খুলনা বিভাগের বিভিন্ন এলাকার চিংড়ি ঘেরে চাষ করা হয়। প্রকৃতিগতভাবে এ পোনা দ্রুত বর্ধনশীল ও টিকে থাকার কারণে খুলনায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক পোনা ব্যবসায়ী।

তিনি জানান, নদী থেকে ধরা এসব পোনা সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে নগদে কিনতে হয়। এছাড়াও অগ্রীম টাকাও দেয়া হয়েছে পোনা আহরণকারীদের। প্রতি পোনা আড়াই থেকে তিন টাকায় বিক্রি করেন তিনি। তারপর চট্টগ্রামের অন্যান্য খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ সব জড়ো করে চালান হয় খুলনা বিভাগে।

একেকজন খুচরা ব্যবসায়ী প্রায় ২৪-৩০হাজার পোনার চালান দিতে পারে দুই তিনদিন অন্তর অন্তর। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নগদে কেনা পোনা বিক্রি করে তেমন একটা পোষা না বলেও জানান এ ব্যবসায়ী। তিনি জানান, সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে যে চিংড়ি পোনা ধরা হয় তাতেও তার প্রায় ২৪ হাজার চিংড়ি পোনা ছিল। এতে অনেক টাকার লোকসান হয়ে গেছে।

.

জানাগেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় নেয়াকালে সীতাকুণ্ডে বাসে তল্লাশি করে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩ দফায় ২৭ লাখ চিংড়ি পোনা জব্দ করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিন।

তিনি পাঠক ডট নিউজকে জানান, নিয়ম হচ্ছে হ্যাচারীর মাধ্যমে চিংড়ি পোনা উৎপাদন করা। কিন্তু হ্যাটারীর মাধ্যমে চিংড়ির পোনা উৎপাদন করতে গেলে তাদের খরচ পড়ে অনেক। যেমন- ২৭ লাখ চিংড়ি পোনা উৎপাদন করতে তাদের খরচ পড়বে ২৮ কোটি টাকা।

.

এতো টাকা খরচ না করে তারা সহজে কর্ণফুলী নদীর মোহনা এলাকা এবং বঙ্গোপসাগরের সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় এলাকা বাঁশবাড়িয়া কুমিরা থেকে অবৈধভাবে চিংড়ি পোনা শিকার করছে। এতে করে সাগরে অন্য প্রজাতির মাছের উৎপাদন নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় দেখা যাবে নদী বা সাগরে মাছের অকাল দেখা দিয়েছে।

পোনা সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জনাগেছে, রাবারের টিউবের বয়া, ডেকচি, সাদা থালা, প্লাস্টিকের সাদা চামচ নিয়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে শত শত লোকজন চিংড়ি পোনা আহরণ করে চলেছে প্রতিদিন।

ভাটার সময় চিংড়ি পোনা আহরণের উপযুক্ত ক্ষণ বলে জানায় আহরণকারীরা। তারা জানান, প্রতিদিন দু-তিনশত পোনা ধরতে প্রতিজন। এসব পোনা আহরণ করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি চিংড়ি দুই টাকা দামে বিক্রি করেন। চট্টগ্রামের অন্তত ৩৬ এলাকা থেকে তারা চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে খুলনা পাঠায় বলে জানায়।

.

জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী অংশের পশ্চিম গোমদন্ডী , চরখিজিরপুর, চরখিদিরপুর, পূর্ব কালুরঘাট, কধুরখীল, চরণদ্বীপ, ভান্ডালজুড়ি এলাকায় চিংড়ির পোনা আহরণের দৃশ্য চোখে পড়ে। পোনা সংগ্রহের জন্য অন্য জেলা থেকেও লোকজন নিয়ে আসেন পোনা ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা । এসব শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক খাটানো হয়।

তবে একটি চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৯৬টি অন্য প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস করে ফেলছে পোনা সংগ্রহকারীরা। এতে করে নদীতে মাছের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে বলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া ২০০৭ সালে চিংড়ি পোনা আহরণের উপর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লতিফা ভুঁইয়া ও তাঁর ছাত্রদের এক গবেষণা জরিপে বলা হয়, কর্ণফুলীতে প্রায় ৭৬ প্রজাতির মাছ বিচরণ ছিল। ২০০০ সালের অধ্যাপক কামাল ও তাঁর ছাত্রদের অপর এক জরিপে দেখা গেছে, কর্ণফুলীতে বিচরণ করেছে মাত্র ৫৪ প্রজাতির মাছ। কর্ণফুলীর প্রায় ২২ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে গবেষণায় উঠে আসে।