অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

মমতাময়ী “মা”

1
সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু

আজ ১৪ মে বিশ্ব মা দিবস। প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্ব মা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিটা সন্তানের বেড়ে ওঠার পিছনে “মা-বাবা” দু’জনের অবদানই অনস্বীকার্য। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যকে চিন্তা বা কল্পনাই করা যায় না। কারো কারো জীবনে হয়তো শুধু মা, আবার কারো কারো জীবনে বাবাই সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে স্থান নিয়ে আছে। তথাপি কোন সন্তান তার জন্ম-লালন-পালন-শৈশবের সকল চাওয়া-পাওয়ার পিছনে তার মা-বাবার অবদানকে অস্বীকার করতে পারবে না। যে কোন সন্তানের সাথেই মা-বাবার আত্মার সম্পর্ক থাকে। মা-বাবার জন্যেও প্রতিটি সন্তানেরও ঠিক তদ্রƒপ আত্মার সম্পর্ক থাকা উচিত। যেমনটি ঘুমিয়ে আছে শিশুর মাতা-পিতা সব শিশুরই অন্তরে। সবাইকে বুঝতে হবে আজকে যারা কোন মায়ের, কোন বাবার সন্তান তারাই একদিন অন্য কারো মা-বাবা। মা-বাবার শব্দযুগলে অলৌকিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। সমস্ত পৃথিবীর আদি-অন্ত যেন এই শব্দ যুগলের মাঝেই নিহিত আছে।

.

মা, আম্মু, আম্মা, আম্মি, মাম্মি, মাতা, ম্যাম্যা, মম এভাবে আমরা নিজ নিজ পরিবেশ-সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে যার যার প্রিয় ‘মা’কে সম্বোধন করি। পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বকালের সর্বাধিক উচ্চারিত কোন শব্দের যদি পরিসংখ্যান নেয়া যায় তবে দেখা যাবে ‘মা’ শব্দটিই হবে সর্বাধিক উচ্চারিত। মা’ শব্দটি অতি ছোট্ট ও ক্ষুদ্র কিন্তু বিশাল ও ব্যাপক তার প্রভাব। বিশ্বাস-আস্থা আর ভালোবাসার অপর নাম মা। মায়ের মমতার তুলনা নাই। কদাচিৎ কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছাড়া পৃথিবীর সকল মা’ই তার সন্তানদের নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসেন। সন্তানের জন্য তার জীবনটাই উৎসর্গ করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না একজন ‘মা’। সন্তানের জন্য একজন মা তাঁর জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন এমন নজীর ভূরি ভূরি।

১০ মাস ১০ দিন সন্তানকে পেটে ধারণ করে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ কর্ম চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এবং সন্তান জন্মের সময় প্রসব বেদনা সয়ে একজন মা’ই সব কষ্ট সহ্য করে। যেই মাত্র প্রিয় সন্তানের চেহারা দেখবে সব কষ্ট মুহূর্তে ভুলে যাবে। এটা একমাত্র মা’র পক্ষেই সম্ভব। ‘ভালোবাসা’ আর ‘মা’ একে অপরের পরিপূরক বা সমার্থক। এটা সবাইকে একবাক্যে স্বীকার করতে হবে যে, ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রধানতম আশ্রয় কিন্তু মায়ের ভালোবাসায়।’ ভালোবাসার সত্যিকারের নিদর্শন কিন্তু একজন মা’র কাছেই পাওয়া যাবে। পৃথিবীতে একজন মা’র পক্ষেই সম্ভব সর্বাধিক ভালোবাসা দেয়া। তাই বলে অন্য কোন সম্পর্কে যে ভালোবাসা কম তা আমি বলছি না তবে মা’র ভালোবাসা সবকিছুকে ছাঁপিয়ে….অনেকদূর এগিয়ে।

অনেক অনেক ঘাত-প্রতিঘাতেও কিন্তু একমাত্র মায়ের ভালোবাসাই পাশে থেকে যায়। সম্পর্কের তিক্ততায় বা টানাপোঁড়েনে যখন আপনার পাশে আপনার প্রিয় বাবা, প্রিয় ভাই বা বোন, বন্ধু, সহধর্মিনী অথবা যে কোন সম্পর্কের প্রিয়জন আপনাকে ছেড়ে চলে যায় তখন কিন্তু এই গর্ভধারীনি মাকেই পাশে পাওয়া যায়। মায়ের ভালোবাসা হচ্ছে অদ্বিতীয়। মায়ের এই ভালোবাসার সাথে কারো তুলনা হয় না। হাতে গোনা দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তুলনা হতে পারেও না।

পৃথিবীতে ‘মা’ সবচেয়ে বড় ধন, সেটা ঠিক আছে। পৃথিবীতে ‘মা’ শব্দটি সবচেয়ে প্রিয় ও মধুরতম শব্দ সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের সন্তানদেরও যে নৈতিক দায়িত্ব কর্তব্য মায়ের মন রক্ষা করে চলা, মায়ের মর্যাদা রক্ষা করে চলা, মায়ের মনে কষ্ট না দেয়া সেটা কী আমাদের মনে থাকে? সেদিকে আমাদের সবার লক্ষ্য রাখা উচিত। মা-বা যখন বার্ধক্যে এসে উপনীত হয় তখন তাঁরা ছোট শিশুর মতো অবুঁঝ হয়ে যান। তাঁরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন অসহায় হয়ে পড়েন। মা-বাবা হয়ে পড়েন ছেলে-মেয়ে আর সন্তান হয়ে যান বাবা-মা। বার্ধক্যে ও অসুস্থতায় তাদের সাথে মধুরতম ব্যবহার করা উচিত প্রতিটি সন্তানের।

এতোক্ষণ পৃথিবীর সব মায়ের কথা বললাম এবার একটু আমাদের মা’কে নিয়ে বলি। আমার মমতাময়ী ‘মা’ আমাকে কতটুকু ভালোবাসেন তা তিনি বা আমি কেউ পরিমাপ করতে পারবো না। আমরা কেউ যদি কোন জরুরী প্রয়োজনে বাসায় ফিরতে গভীর রাত করে ফেলি, যত রাতই হোক না কেন তিনি ভাত না খেয়ে, ঘুম না গিয়ে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে বেলকনিতে ঠাঁয় বসে থাকবেন। কোন বিপদ-আপদ হলে সামনের দিক থেকে আমাদের ভাইদেরকে সরিয়ে দিয়ে আমাদের মা’ই অগ্রভাগে অবস্থান করেন যেন বিপদ হলে তাঁর হবে তবুও আমাদের যেন না হয়। বেশ কয়েক বছর থেকে তিনি হৃদরোগ ও ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত। যার কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে ট্রিটম্যান্ট করতে হয় তারপরেও এ অসুস্থ্য শরীর নিয়ে সন্তানদের জন্য সব সময় টেনশন করবেন অথবা আমাদের কার কি প্রয়োজন তার দিকে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবেন।

চার ভাইয়ের মধ্যে ছোটটি এখনো বিয়ে করেনি, ঘরে তিন তিনটি বউ থাকার পরেও কিন্তু আমাদের প্রিয় মা’টি এখনো সন্তানদের ভালো-মন্দের সব ব্যাপারে লক্ষ্য রাখেন। এই করা ছাড়া যেন তাঁর আর কোন কাজ নেই। আমাদের একান্নবর্তী সংসারের মূল কর্তৃত্ব ‘মা’র হাতেই থাকে। অতিথি বা মেহমানদের সমস্ত আয়োজন আমাদের মা’ই করে থাকেন। ছেলেদের বউরা হেসেলে উনার সহকারী-সহযোগী মাত্র। নাতি-নাতনিদের সকল আবদার তাদের দাদুন অর্থাৎ দাদীর কাছেই। স্কুল আর লেখাপড়ার সময় বাদ দিয়ে সারাক্ষণ তারা দাদীর পিছন পিছন ঘুর ঘুর করে। মনে হয় যেন দাদীই তাদের প্রাণ। এটা খুঁজে পাচ্ছে না, তো দাদুন, এ ও’র সাথে ঝঁগড়া লেগেছে তো দাদুন। মোটামুটি দাদুনকে সারাদিন ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় তাদের নিয়েই। সেই ছোট বেলায় এটা চাই, ওটা চাই সবকিছুর আবদার, সব বায়না কিন্তু আম্মুর মাধ্যমেই আব্বুর কাছ থেকে পাস করিয়ে নিতাম। আমরা ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে আমার ইমিডিয়েট ছোট বোনটি ৪/৫ বছর বয়স থাকা অবস্থায় মারা যায়।

সেই থেকে আমাদের ৪ ভাই ১ বোনের সবাইকে যেন নিজের আঁচলের নীচে পরম মমতায় আগলিয়ে রেখেছেন এখনো। সবার উপস্থিতিতে ঘর ভর্তি না থাকলে আমাদের মনটা টিকে না। বিশেষ করে সেটা আম্মার বেলায় আরো বেশী প্রযোজ্য। এমনিতে বাসায় থাকলে এটা ওটা নিয়ে আম্মার সাথে আব্বার প্রায়ই খিটির মিটির লেগে থাকে কিন্তু যেই আম্মু কোথাও বেড়াতে গেছেনতো ২ দিনের বেশী করলে আব্বার আর প্রাণ সয় না, ফোনের পর ফোন করিয়ে আম্মাকে নিয়ে আসবেন।

আমার প্রিয়তম ‘মা’ আমাকে খুবই ভালোবাসেন। তবে আমি এটা বুঝতে পারিনা কে বেশী আমাকে ভালোবাসেন, ‘মা’ না ‘বাবা’। আজতক বুঝতে পারিনি, পরিমাপ করে দেখার দুঃসাহসও দেখাই নি। একবার মনে হয় মা আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন আবার মনে হয় বাবাই বেশী ভালোবাসেন। কেউ যেন কারো চেয়ে ভালোবাসায় কম যান না। এতেই আমি খুব বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আমাদের প্রতি তাদের ভালোবাসার কমতি নেই দেখে পুলকিত বোধ করি। বাসায় মেহমানদারীর কথা আর কি বলবো। আমাদের মা-বাবা মেহমান আসাটাকে খুবই পছন্দ করেন। সেই ছোটকাল থেকে অদ্যবধি দেখে এসেছি মাসে বেশ কয়েকদিন বাসাভর্তি মেহমান না থাকলে আম্মুর মনটা তেমন জমে না। আজো সেই ধারা অব্যাহত আছে। বড় ভাই, মেজ ভাই, ছোট বোন সর্বশেষ আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকজনের আনাগোনাকে তিনি খুবই পছন্দ করেন এবং আব্বা-আম্মার বাপের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনতো আছেই। হয়তো মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে তাই এখন কিছুটা কমে এসেছে না হলে ছোট বেলায় দেখতাম মাসের প্রায় অর্ধেক দিনই বাসায় মেহমান ভর্তি। এবং আতিথেয়তার কোন রূপ কমতি ছিলো না।

সব অতিথি ও আত্বীয় স্বজনের মুখে একজনেরই প্রশংসার ফুলঝুড়ি তিনি আর কেউ নন, আমাদের মা। যে কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হলো তিনি তাঁর ছেলের বউদের কিন্তু ধিরে ধিরে তাঁর মতো অতিথি পরায়ণ করে গড়ে তুলছেন। এখানে শ্বাশুড়ি হিসেবেও সফল। আর বিশেষ করে গ্রামের বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের অসুস্থতায় চট্টগ্রাম শহরের মেডিক্যাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হলে তাদের আত্মীয় স্বজনদের অবস্থান হতো আমাদের বাসায়। যেটুকু জায়গা আছে সেটাতেই সবাই শেয়ার করে থাকতাম। আমার কাজ থাকতো মেডিক্যাল, ক্লিনিক, ডাক্তার, ল্যাব সবকিছুর সমন্বয় করিয়ে দেয়া। আর এর সবকিছুরই প্রধান সমন্বয়ক, তত্ত্বাবধায়ক, পরামর্শদাতা কিন্তু আমার মা’ই।

২০০৩ সালে আব্বা একবার এক্সিডেন্ট করলে পরবর্তীতে ব্রেইনে অপারেশন করতে হয়। অপারেশনের আগ থেকে শেষ না হওয়া পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা আম্মা কেবিনে জায়নামাজের উপর বসে ছিলেন। স্বামীর সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর কাছে সেই কী মিনতি। আমাদের জীবনে এভাবে অনেক কঠিন, কষ্টের সময় পার করেছি। টেনশন, ভয়, আশংকা, আশা, সবকিছুর সাথে স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গি ছিলেন আমাদের প্রিয় মা। তিনি কখনো হতাশ হয়ে পড়েন নি, শক্ত হাতে হাল ধরে থেকেছেন। এই হচ্ছে আমার মা, আমাদের প্রিয় মা, অনেকের মা’র চেয়ে আলাদা, ঠিক যেন আলোকবর্তিকা, পশ্চিমাকাশের দ্রুবতারা।

বাবা-মাকে তো আমরা প্রতিদিনই ভালোবাসি, মা তো আমাদের প্রতিদিনই প্রিয়। তবুও কেন শুধুমাত্র একটা দিন ঘটা করে মা দিবস পালন করে আমরা তাঁর সম্মানকে খাটো করব? এ সমস্ত প্রশ্ন যাদের মনে জাগে তাদের প্রতি বিনয়ের সাথে বলবো ঘটা করে মাদার ডে পালন করা মায়ের সম্মানকে খাটো করার জন্য নয়, প্রতিদিনের মতোই ওই দিনকে আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে শুধুমাত্র মা’র জন্যই ঐদিনকে আরো বেশি সম্মানের আসনে স্মরণ করা। মা’কে মুগ্ধতায় বুঝিয়ে দেয়া এদিন সারাবিশ্ব শুধু তাঁকে নিয়েই বন্দনা করবে। সবার উদ্দেশ্যে বলব আমরা কি বাঙালি নই, বাঙালি পরিচয় দিতে আমরা তো সাচ্ছন্দবোধ করি। তবুও কেন বছরের ১টা দিন পহেলা বৈশাখ আমরা সবাই বাঙালি সাজি। কারণ বছরের ঐ দিনটি সবাই মিলেমিশে আনন্দে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠি।

আবার অন্যদিকে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ঈদের দিন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দূর্গা পূজোর দিন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বুদ্ধ পূর্ণিমা, খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বড় দিনের মতো উৎসবের দিনগুলোতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে। কারণ সেইদিনগুলো শুধুই আনন্দের জন্য। আবার আমরা ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১টা দিন ভালোবাসা দিবস পালন করি, তবে কি ভালবাসা অন্য দিনে থাকে না? ১ জানুয়ারি নিউ ইয়ার ঝাঁকঝমকভাবে পালন করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এ উৎসব পালন করে। তাই বলে কি ৩৬৪ দিন মানুষের জীবন থেকে বাদ পড়ে? তবে মাদার ডে পালন করতে গিয়ে গতানুগতিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে হবে না, লক্ষ্য রাখতে হবে এই দিনটি পালন করতে গিয়ে অন্যান্য দিনে মা’র প্রতি অবহেলা যেন করা না হয়। তাই আসুন মা’র প্রতি প্রতিদিনের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-ভক্তির পাশাপাশি মাদার ডে’তে আমরা সারা বিশ্বের মা’দের প্রতি ভালোবাসাকে উজাড় করে দিই। এ দিনটিতে বিশ্বের সকল মা’কে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আন্তরিক শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।

লেখকঃ সংগঠক ও প্রাবন্ধিক

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।

১ টি মন্তব্য
  1. Hridoy Hasan বলেছেন

    Dhonnobad pathok news