অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

চৌকশ কর্মকর্তাদের কৌশলে বদলী, বেহাল দশা সিএমপি’র!

0
সিএমপি
ছবি: সিএমপি’র ফেসবুক পেইজের প্রচ্ছদ ছবি

তিন পুলিশ কর্মকর্তার আধিপত্য স্থায়ী করতেই চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)কে অকেজো করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, চৌকস ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সিএমপি থেকে একে একে বদলি করানোর ক্ষেত্রে নগর পুলিশের কয়েকজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তার যোগসাজেশ আছে।

বর্তমানে সিএমপিতে অনেকটা স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে স্বীকার করেছেন কমিশনার ইকবাল বাহার নিজেও।

নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে সম্প্রতি বদলি হয়ে আসা কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের বদলি করে দেয়ার ক্ষেত্রে জড়িত। এদের মধ্যে দুজন উপ কমিশনার পদমর্যাদাসহ তিনজনের সিন্ডিকেট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএমপি ডিবিতে কর্মরত ছিলেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছরে সিএমপি ডিবিকে ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। ডিবি থেকে কৌশলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে কুসুম দেওয়ানকে।

0,,18805340_304,00
ফাইল ছবি, সিএমপিতে কর্মরত পুলিশ সদস্য

উক্ত পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সিন্ডিকেটের তিনজনের একজনের উক্তি এরকম ‘নো কনস্টেবল, নো এসআই, নো ওসি, নো এসি আই এম অনলি ওয়ান’। তিনজনের সিন্ডিকেটের এই প্রধানের কারণেই মূলত সিএমপি’র আজ এ বেহাল দশা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা বলেন, টিমওয়ার্ক করতে গেলে মাথার উপর ছায়া থাকতে হয়। বনজ স্যার, কুসুম স্যাররা আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়েছিলেন। এখন যারা আছেন, তারা না বুঝেন অপরাধীর মনস্তত্ব কিংবা চট্টগ্রামের পরিস্থিতি, না পারেন কোন নির্দেশনা দিতে।

ন্যুনতম সূত্রবিহীন চাঞ্চল্যকর ঘটনা থেকে শুরু করে অপহরণ, জোড়া খুন, ব্যাংক ডাকাতি সবখানেই ডাক পড়ত যাদের। জামায়াত-শিবিরের নাশকতা মোকাবেলার অগ্রভাগেও ছিলেন যারা। কিন্তু গত এক বছরে সিএমপি থেকে একে একে বিদায় নিয়েছেন এসব অধিকাংশ চৌকস কর্মকর্তা। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নখদর্পণে রেখে অপরাধ দমন করতে পারেন, এমন কর্মকর্তা এখন সিএমপিতে খুব বেশি নেই।

দক্ষ, আন্তরিক এবং চৌকস এসব কর্মকর্তাদের হারিয়ে সিএমপি এখন পরিণত হয়েছে অনেকটা নিধিরাম সর্দারে। এখন অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী গ্রেফতার দূরের কথা, এর কারণ উদঘাটন করতেই হিমশিম খাচ্ছেন সিএমপির কর্মকর্তারা। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম ওরফে মিতু আক্তারের নির্মম হত্যাকাণ্ড।

গত ৫ জুন ভোরে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে মিতু আক্তারকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ৮ দিন পার হয়ে গেলেও সেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কারণও এখনও উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

এ বিষয়ে সিএমপি কমিশনার মো.ইকবাল বাহার বলেন, সরকারি চাকরি বদলির চাকরি। তারপরও দক্ষ কর্মকর্তার বদলিজনিত কারণে তাদের অভাব আমাদের কিছুটা ভোগাচ্ছে। কাজকর্মে কিছুটা স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই স্থবিরতা খুব বেশিদিন স্থায়ী হবেনা। সিএমপিকে গতিশীল করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

police_433487696
সিএমপির দুই চৌকস অফিসার মহিউদ্দিন সেলিম ও মোহাম্মদ মহসিন

একসময় চট্টগ্রাম নগরীতে স্পর্শকাতর কোন অপরাধ ঘটলেই ডাক পড়ত উপ-পরিদর্শক (এস আই) সন্তোষ কুমার চাকমা কিংবা রাজেশ-আফতাবের। ডাক পড়ত এস আই জহির-কামরুজ্জামানের। ডাক পড়ত সহকারি কমিশনার (এসি) শাহ মো.আব্দুর রউফ, ওসি জাহিদুল ইসলাম, একেএম মহিউদ্দিন সেলিম, মো.মহসিনের ।

রোববার পুলিশ মহাপরিদর্শকের সামনে সুধী সমাবেশে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতি প্রশ্ন করেছিলেন কার স্বার্থে সিএমপি থেকে এসব অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হল ?

চৌকস এসব কর্মকর্তাদের টেবিলের সামনে বসিয়ে সেই অপরাধের রহস্য উন্মোচনের খুঁটিনাটি পরিকল্পনা নিতেন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আক্তার, এস এম তানভির আরাফাত কিংবা মোস্তাক আহমদের মতো কর্মকর্তারা। তাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকতেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (বর্তমানে ডিআইজি) প্রকৌশলী বনজ কুমার মজুমদার।

004_213127
ফাইল ছবি: সিএমপির বর্তমান কমিশনারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে এবং দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ভাগে নগরীতে জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড প্রতিরোধে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন বনজ কুমার মজুমদার।

নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে সিএমপি কমিশনারের পর যে কর্মকর্তার উপর পুলিশ সদর দপ্তর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করত তিনি হচ্ছেন বনজ কুমার মজুমদার।

গত বছর সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) পদ থেকে তাকে বদলি করা হয় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে। ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি বর্তমানে আছেন পিবিআই হেডকোয়ার্টারে।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার পদে ছিলেন কুসুম দেওয়ান। ঠান্ডা মাথায় অধ:স্তন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে তার ভূমিকা পুলিশ সদর দপ্তরে প্রশংসনীয় ছিল। অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া কুসুম দেওয়ানকেও সম্প্রতি সিএমপি থেকে বিদায় দেয়া হয়েছে। তিনি এখন চট্টগ্রাম রেঞ্জে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে আছেন।

cmp_commisioner_21513
সিএমপির বর্তমান কমিশনার ইকবাল বাহার

সূত্রমতে, কোতয়ালি থানায় উপ-পরিদর্শক পদে কর্মরত ছিলেন এস আই জহির ও কামরুজ্জামান। পুরো নগরীতে ছিনতাইকারী, পেশাদার খুনি, ব্যাগ টানা পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, গামছা পার্টি, গ্রিল কাটা পার্টি, ছিঁচকে চোর, পেশাদার ডাকাতদের তালিকা তাদের মুখস্থ ছিল।

কোতোয়ালি থানার বাইরেও কোন ঘটনা ঘটলে এস আই জহির ও কামরুজ্জামান তাদের খুঁজে বের করে ফেলতে পারতেন। বিশেষত ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহার আগে ছিনতাই ঠেকাতে তারা সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকতেন। তাদের দুজনকেই ডিএমপিতে বদলি করা হয়েছে।

এস আই জহির-কামরুজ্জামানের টিমের নেতৃত্ব দিতেন কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি একেএম মহিউদ্দিন সেলিম, পরিদর্শক (তদন্ত) নেজাম উদ্দিন ও সেকেন্ড অফিসার উৎপল কান্তি বড়ুয়া। তাদের টিমওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

অভিযোগ আছে, নেজাম, উৎপল, জহির ও কামরুজ্জামানকে বদলির মধ্য দিয়ে একেএম মহিউদ্দিন সেলিমকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। তাকেও কোতোয়ালি থেকে বন্দর থানায় পাঠানো হয়েছে। নেজাম আর উৎপলকে অপরাধ বিভাগ থেকে সরিয়ে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে দেয়া হয়েছে।

সিএমপি হেডকোয়ার্টারে কর্মরত সাবেক এক ওয়ারলেস অপারেটর বলেন, মহিউদ্দিন সেলিম স্যারের কারণে রাতের বেলায় সিএমপির কোন থানার অপারেটরা ঘুমাতে পারতেন না। সার্বক্ষনিক সজাগ থাকতে হতো কোন সময় কি ঘটে তার খবর নেয়ার জন্য। সারা রাত তিনি তাঁর পুরা থানা এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন।

সূত্রমতে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ দমনে অভিজ্ঞ এস আই সন্তোষ কুমার চাকমা, রাজেশ ও আফতাব নগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত ছিলেন। জঙ্গি দমন অভিযানে নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার বাবুল আক্তারের (বর্তমানে পুলিশ সুপার) সঙ্গে এই তিনজন ছিলেন অগ্রভাগে।

জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস দমনের অভিযানে, চাঞ্চল্যকর হত্যকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে নগর গোয়েন্দা পুলিশের আরেক অতিরিক্ত উপ কমিশনার এস এম তানভির আরাফাতের সহযোগীও ছিলেন তারা। বদলির মাধ্যমে সুকৌশলে সেই টিমওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

এস এম তানভির আরাফাতকে আগেই র‌্যাবে বদলি করা হয়েছে। বাবুল আক্তার পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পাবার পর তাকেও পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি করা হয়েছে। এস আই সন্তোষ কুমার চাকমা, রাজেশ ও আফতাবের ঠাঁই হয়েছে পিবিআইতে।

নগর পুলিশের আরেক দক্ষ কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ কমিশনার মোস্তাক আহমেদকেও র‌্যাবে বদলি করে সিএমপি থেকে বিদায় দেয়া হয়েছে।

অপরাধ দমনে আলোচিত সহকারি কমিশনার শাহ মো.আব্দুর রউফ বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে সম্প্রতি আবারও অপরাধ বিভাগে ফিরেছেন। আছেন দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত উপ কমিশনার পদে। আরেক চৌকস কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি কমিশনার কামরুজ্জামানকেও সিএমপি থেকে বদলি করা হয়েছে। তবে তাঁদেন দু’জনকে অনেকটা ক্ষমতাহীন কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে বলে জানান পুলিশের একটি সুত্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, এখনও সিএমপিতে কয়েকজন চৌকস দক্ষ কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু তাদের তো দক্ষ সহযোগি নেই। অপরাধ দমনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টিমওয়ার্ক। সেই টিমওয়ার্কই তো নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। পেশাদার অফিসারদের ক্ষমতাহীন করে ফেলা হয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতির বক্তব্যের পর বদলি হওয়া চার উপ-পরিদর্শক (এস আই) ফের সিএমপিতে ফিরছেন। রোববার তাদের চারজনকে সিএমপিতে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। তাদের অবিলম্বে সিএমপিতে যোগদানের জন্য বলা হয়েছে।

চার চৌকস কর্মকর্তা হলেন, এস আই মো.আফতাব হোসেন, রাজেশ বড়ুয়া, সন্তোষ কুমার চাকমা এবং এস আই শিবেন বিশ্বাস।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হকের নির্দেশে রোববার সন্ধ্যায় তাদের সিএমপিতে স্ট্যান্ড রিলিজের আদেশ জারি করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) বিনয় কৃঞ্চ বালা।

তবে প্রশ্ন থাকে যে তিনজনের সিন্ডিকেটের মাঝে ছায়া বিহীন তাঁরা কতটুকু স্বাধীন এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে পারবেন।