অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের একজন জীবন্ত কিংবদন্তীর গল্প

0

সেই ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশের মতো একটা দেশে সাত বছর বয়সী একটা ছেলে কি করতে পছন্দ করার কথা? উত্তর সিংহভাগ ক্ষেত্রেই হবে বাসায় খেলনা দিয়ে খেলতে, কিন্তু একটা সাত বছর বয়সী ছেলে সেই সময় এই দেশে বাস করতো যে হাউয়াইন গিটারে টুংটাং করতো তার অবসর সময়ে। এবং, কে জানতো যে এই টুংটাং করা সাত বছর বয়সী ছেলে বড় হয়ে তার দেশ ও সময়ের অন্যতম বড় একজন মিউজিসিয়ান এবং বেজিস্ট হবে?

হ্যা, আপনারা সঠিকই ধরেছেন, আমি অর্থহীন ব্যান্ডের সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমনের কথাই বলছি। “বেজবাবা সুমন” নামেই যাকে মানুষ বেশি চিনে।

বেজবাবা সুমন

১৯৭৩ সালের ৮ই জানুয়ারিতে এই মহান বেজিস্ট জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৭ বছর বয়সেই হাউয়াইন গিটার দিয়ে সে সংগীতচর্চা শুরু করে। একটা ইন্টার্ভিউতে সে বলে একসময় সে স্প্যানিশ গিটার কিনতে অক্ষম ছিলো তাই সে তার হাউয়াইন গিটার মিউজিক শপে নিয়ে গিয়ে তখনকার সময়ের ৫০০ টাকা দিয়ে সেটাকে স্প্যানিশ গিটারে রুপান্তর করে।

তার দুই বছর পর সে “আইরন মেইডেন” এর একটা মিউজিক ভিডিও দেখে আর সেখানের বেজিস্ট “স্টিভ হ্যারিস” এর বেজ প্লেয়িং দেখে খুবই অনুপ্রাণিত হয় এবং বেজ গিটার প্লে করার কথা চিন্তা করে। সে তার গিটারের দুটো তার ছিড়ে ফেলে দিয়ে সেটাকে বেজ গিটার বানিয়ে প্লে করা শুরু করে তখন তার কাছে বেজ গিটার না থাকায়। সে এভাবে এর পরের দুই বছর আইরন মেইডেনের গানে বেজ বাজানো প্র্যাকটিস করে।

সে তার প্রথম স্প্যানিশ গিটার কিনে এবং ব্যান্ড ফর্ম করে যখন তার বয়স ১২ হয় এবং সে ১৫ বছর বয়স থেকে বেজ গিটার বাজানো শুরু করে।

সে ১৭ বছর বয়সে বিখ্যাত মিউজিসিয়ান ফারুক মাহফুজ আনাম বা “জেমস” নামে যাকে মানুষ বেশি চিনেন, তার তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিলিংসে বেজিস্ট হিসেবে যোগ দেয়। মাঝে সুমন ও তার বন্ধুরা মিলে “সাইলেন্স” নামে একটা ব্যান্ড খুলেছিলো কিন্তু তা পরে ভেঙে যায়। এরপরেই সুমন বাংলাদেশের হেভী মেটালের পাইওনিয়ার ব্যান্ড ওয়ারফেজে যোগ দেয় বেজিস্ট এবং ভোকালিস্ট হিসেবে এবং পাশাপাশি তার বিভিন্ন সলো প্রজেক্ট সম্পাদন করতে থাকে।

এমনই ১৯৯৭ সালে তার সলো এলব্যামের নাম “সুমন ও অর্থহীন” থেকে তার একটা ব্যান্ডের নাম এবং আইডিয়া আসে এবং ১৯৯৮ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রক ব্যান্ড “অর্থহীন” গানগুলোর লিরিক্স এবং কম্পোজিশন সবসময় শ্রোতাদের মন জয় করে এসেছে। অর্থহীন প্রধানত রক ব্যান্ড হলেও এরা অন্যান্য জনরার মিউজিকও করে। সফট মিউজিক থেকে শুরু করে হেভী মেটাল সহ অন্য অনেক জনরার মিউজিক ট্র্যাকও তাদের করা আছে।

বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে বর্তমান সময়ে রক, বিশেষ করে মেটাল এবং অল্টারনেটিভ রক খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এবং এর পিছে সুমন ও তার ব্যান্ড অর্থহীন এর বড় একটা হাত আছে শ্রোতাদেরকে এরকম জনরার মিউজিকগুলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। শুধু তাই নয়, সুমন বাংলাদেশের অন্যতম একজন মিউজিসিয়ান যে অন্য অনেক মিউজিসিয়ানদের মিউজিক করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এ দেশের শ্রোতাসমাজে একজন ভালো বেজিস্টের ভূমিকা কি হতে পারে একটা ব্যান্ডে, সেটা সে বুঝিয়ে দিয়েছে তার কাজের মাধ্যমে।

বেজ গিটার অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুমনের এলব্যামগুলোয়। সে একজন অন্যতম জীবন্ত কিংবদন্তী এ দেশে রক মিউজিক শ্রোতাদের মাঝে তুলে ধরার জন্য।

বেজবাবা সুমন নিয়ে কিছু অজানা তথ্য

১. সে ১৭ বছর বয়সে তার একক(Unaccompanied) বেজ সলো করে।

২. তার বয়স ১৯ বছর হতে হতে সে ১১টা ব্যান্ডে প্লে করে।

৩. তার প্রথম একক এলব্যাম তার ২০ বছর বয়সে বের হয় যেটার গানগুলো তার নিজেরই লেখা, গাওয়া এবং সুর করা।

৪. সে তার অতুলনীয় সব বেজ গ্রুভ, বিভিন্ন বেজ প্লেয়িং টেকনিকের অসাধারণ ব্যাবহার এবং বিশেষ করে তার ব্যান্ড অর্থহীনের বিভিন্ন গানে করা সব বেজ সলোর জন্য অনেক জনপ্রিয়।

৫. বেজবাবার আরেকটা গুন যেটা তার ভক্তদের খুবই পছন্দ সেটা হচ্ছে তার লিখা লিরিক্সগুলো। এক একটা লিরিক্স, এক একটা মাস্টারপিস এবং অতুলনীয়।
যেমন, অর্থহীনের একটা গান আছে “ফিটাসের কান্না” নামে যেটা পুরোটাই abortion নিয়ে লিখা।
এটা নিয়ে একমাত্র অর্থহীনেরই এই একটা গান আছে পুরো বাংলাদেশে যেটার লিরিক্স সুমনেরই লিখা।

৬. সুমন কখনো যদি নিজে কোনকিছু অনুভব না করে বা খুব কাছের মানুষের কোন কিছু খুব কাছের থেকে অনুভব না করে, সেটা নিয়ে সে লিরিক্স লিখতে পারে না।

৭. সুমন একবার আমেরিকা গিয়ে এক কফি হাউজের বাইরে বসে থাকাকালীন সেখানের লোকাল এক বাঙালি হিন্দু বিবাহিত মহিলার সাথে তার পরিচয় হয়। যিনি পরে তার একজন বান্ধবী হয়ে যান এবং এটাও জানতে পারে যে সে একজন মিউজিসিয়ান এবং সুমনের দেশে আসার পরেও তার সাথে যোগাযোগ ছিলো, খোঁজখবর নেয়া হতো এবং প্রায়ই সুমনের জন্য গিফট পাঠাতো। একবার একটা গিটার গিফট পাঠিয়ে বলে তাকে নিয়ে একটা গান লিখতে কিন্ত ব্যস্ততার কারনে সেটা করা হয়ে উঠে না এবং একসময় জানায় যে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং পরে একদিন মহিলার স্বামী সুমনকে জানায় যে সেই মহিলা মারা গিয়েছেন ক্যান্সারের কারনে এবং সুমন এতো কষ্ট পায় যে সে সাথে সাথে বসে কাগজ কলম নিয়ে একটা গান লিখে সেটার সুর সেই পাঠানো গিটার দিয়ে করে ফেলে সেই এক বসাতেই খুবই অল্পসময়ের মধ্য। সে গানটাই হচ্ছে অর্থহীনের সর্বশেষ বের হওয়া এলব্যাম “ক্যান্সারের নিশিকাব্য” এর “নীল পাহাড়ের গায়ে” গানটা।

৭. সুমনের ব্যান্ড অর্থহীনের অনেক গান তার ব্যান্ড মেম্বার রাফার লিখা, যেমন: “আনমনে”। রাফা সেগুলো ইংলিশে লিখে আনতো এবং সেটা পরে সুমনরা বাংলায় অনুবাদ করে সুর করতো।

৮. সুমনের জীবনে তিনবার অর্থহীন সঙ্ক্রান্ত কারনে চোখে পানি এসেছিলো।

অর্থহীনের বয়স তখন ৭/৮ মাস বয়স হবে। সে মিউজিক সিনে পরিচিত হলেও ব্যান্ড হিসেবে তারা ছিল নতুন। একটা বড় কনসার্টের অফার পেয়ে সবাই খুশি কিন্তু শেষ পর্যন্ত কনসার্ট টা করতে পারেনি তারা। কারনটি সুমনের ভাষ্যমতে, “একটি ‘বড়’ ব্যান্ডের ব্যান্ড লিডার এবং ‘লেজেন্ড’ মিউজিসিয়ান অরগানাইজারদের বলেছিল অর্থহীন সেদিন কনসার্ট করলে তারা শো করবেনা।” সঙ্গত কারণেই অর্থহীনের মত ’চুনোপুঁটি’ ব্যান্ডের বাদ পড়তে হয়েছিল সেই কনসার্ট থেকে। চোখ ভিজে উঠেছিলো সেই কারনে সুমনের
অর্থহীনের প্রথম অ্যালবাম ‘ত্রিমাত্রিক’ রিলিজ হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। জি-সিরিজের এলিফ্যান্ট রোডের শোরুমে সিডিটা ঢোকানো। প্লে বাটন টা চাপ দিলাম। অদ্ভুত সেই ছেলেটি ‘লা লা লা’ বেজে উঠলো স্পিকার। সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। সুমনের চোখ ভেজা।
১২ বছর পর রাফার অর্থহীন থেকে বিদায় নিতে হল। অর্থহীন, অ্যাভয়েড রাফা, ক্রিপটিক ফেইট এবং রাফার অন্যান্য প্রফেশনাল কাজ নিয়ে একসাথে সবকিছু ম্যানেজ করাটা রাফার জন্য খুবই কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর কারনে অর্থহীন এবং অ্যাভয়েড রাফা… দুটো ব্যান্ডেরই অনেক ধরনের স্যক্রিফাইস করতে হচ্ছিলো। যাইহোক, ১৩ বছর আগের অর্থহীনের ‘ধ্রুবক’ অ্যালবামের সেই ট্যালেন্টেড টিনেজার প্রডিজি রাফা কে ছাড়ার ঘোষণা দিতে গিয়ে চোখ আবার ভিজেছিলো সুমনের।
৯. ২০১৬তে সুমনের প্রথম বেজ সলো এলব্যাম “সোউল ফুড পার্ট ওয়ান” রিলিজড হয়।সেখানে সে বিশ্বখ্যাত মিউজিসিয়ানদের সাথে যেমন ফেলিক্স পেস্টোউরিস, রবার্ট বাবি লুইস, জোস কোহেন সহ আরো অনেকের সাথে কাজ করেন। বর্তমান অর্থহীনের ড্রামার মার্ক ডনও সেখানের একটা ট্র্যাকে কাজ করেন।

১০. অর্থহীনের “আমার প্রতিচ্ছবি” নামে একটা গান আছে যা সুমন তার ছেলে আহনাফের জন্য লিখে। যেটা প্রায়ই শ্রোতাসমাজ ভুলে বুঝে প্রেমের গান মনে করে।

১১. অর্থহীনের চতুর্থ এলব্যাম “ধ্রুবক” রিলিজের পর সুমনের স্বাস্থ্য খুব বাজেভাবে ভেঙে পড়ে। ২০১১ তে সে সবাইকে জানায় যে তা “স্টোমাক ক্যান্সার” ধরা পড়ে। সার্জারি এবং কেমোথেরাপিরর পর তাকে আবার ক্যান্সারমুক্ত ঘোষনা করা হয় ২০১৩ সালে। সে তার ক্যান্সার নিয়ে “ক্যান্সার” নামে একটা গানও লিখে যেটা অর্থহীনের “অসমাপ্ত ২” এলব্যামে স্থান পায়। এবং কিছু সময় পর তার আবার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং তাকে এ পযন্ত হাত-পা সবমিলিয়ে সর্বমোট ২৪টা সার্জারির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

১২. সুমনের বাবা একবার তাকে জিজ্ঞেস করে যে এই মিউজিক করে সে কতো টাকা পায়। উত্তরে সুমম বলে যে “তেমন কোন টাকা পাইনা, মনের যে শান্তিটা পাই সেটাই অনেক।”

১৩. অনেকেই মনে করে ‘ফিলিংস’ সুমনের প্রথম ব্যান্ড। কিন্তু না, তিনি এর আগে আরো কিছু ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন।

রক ফ্যান্টম (১৯৮৬-৯২)
জলি রজার্স; দুই দফায় তিনি এই ব্যান্ডের হয়ে পারফর্ম করেন। প্রথমে ১৯৮৭-৮৯ সাল পর্যন্ত পরবর্তীতে ১৯৯৩-৯৪সাল পর্যন্ত।
সুইট ভেনম (১৯৮৯-৯০)
সাইলেন্স (১৯৯০-৯২)
ফিলিংস (১৯৯০-৯৩)
এইসেস (১৯৯৩-৯৪)
শাব্দ (১৯৯৫-৯৬)
ওয়ারফেজ (১৯৯৬-৯৯)
অর্থহীন (১৯৯৭-বর্তমান)
ব্ল্যাক (২০০৫-০৬)
ভুতিস্ট (২০০৯)
ব্যাক্তিগত জীবনে সুমন “খালেদ গ্রুপ অফ কোম্পানি” সহ মোট আঠারোটা কোম্পানির ডিরেক্টর এবং সাতটা কোম্পানির সিইও। তারপরেও সে মিউজিসিয়ান হিসেবেই নিজের পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। এছাড়াও সে দুই সন্তানের বাবা। তাদের নাম যথাক্রমে আহনাফ এবং অরোরা। তারা দুজনই তার সাথে তার “বোকা মানুষটা” এলব্যামে গান গেয়েছে।

সুমনের আরো যে জিনিসগুলো ভক্তদের খুবই প্রিয় তা হচ্ছে তার পার্সোনালিটি আর সেন্স অফ হিউমার এবং তার চিন্তাধারা। একবার এক অপারেশনের আগে ডাক্তারকে সে বললো সে বাচতে চায়। কারনটা ছিলো তার ভাষ্যমতে “পিটার জ্যাকসনের দ্যা হবিট মুভিটা দুই দিন পর রিলিজ হবে, আমি সেটা দেখতে চাই।”

এছাড়াও, এই জীবন্ত কিংবদন্তী খুবই পজিটিভ চিন্তাধারার মানুষ, সহজে দুশ্চিন্তা মাথায় নেয় না। জীবনটা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারাটাই তার কাছে মুখ্য।

যেখানে মানুষের একটা অপারেশনের পরেই মনোবল ভেঙে পড়ে, সেখানে তার এতোগুলো অপারেশনের পরেও সে সুন্দর করে তার জীবন উপভোগ করে যাচ্ছে। তার একটা ইন্টার্ভিউয়ে বলেছিলো যে তার বাংলাদেশের সব জেলা ঘোরা শেষ, ইউএসএর আটাশটা স্টেট তার কভার করা শেষ লং ড্রাইভ করে। এতোকিছু তিনি পেরেছেন এবং এখনও পারছেন কারন তিনি বিশ্বাস করেন, “Happiness is a choice and life is beautiful!”