অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

‘তোমার বিরোধী আদর্শের লোকদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করো’

1
জাহিদ আল আমীন

চিন্তায় ভিন্নমতের কারণে কেউ আক্রান্ত হলে কিছু লোক তালিয়া বাজাতে বাজাতে ধেই ধেই করে নৃত্যু শুরু করে দেয়; আবার চিন্তায় সহমতের কেউ অাক্রান্ত হলে সেই লোকই কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ শুরু করে। এ কেমন বাংলাদেশ?
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর একতাবদ্ধ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রতিটি সুনাগরিকের হৃদয়ে পরম যতনে লালন করে রাখা, এই কি সেই বাংলাদেশ? কেন এতো বিভাজন। কেন এতো উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব? কোথা থেকে এমন অতি ধর্মান্ধ চক্রের বিকাশ?

প্রসঙ্গ বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর বর্বর হামলা।
হামলাকারী ঘটনাস্থল থেকে ধৃত। হামলার নির্ভেজাল মোটিভ জানাও এখন সময়ের অপক্ষো। তবে ঘটনার পর থেকে দুইটি ঘৃণা শিবির থেকে যেভাবে পরষ্পরকে উদ্দেশ্য করে ঘৃণা বর্ষণ করা হচ্ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এমন বিভাজন, চিন্তায়, চেতনায়; মতে, পথে এমন দূরত্ব পৃথিবীর আর কোন দেশ ও জাতির মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে কী না, জানা নেই।

.

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরে যেখানে সব মত ও পথ নির্বিশেষে এমন ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদে সকলের সোচ্চার হবার কথা, সেখানে দুই শিবিরের সেনানীরা ইতিহাস খুড়ে আগেকার যতরকম বস্তাপচা গল্প-গুজব, কাঁদা ছোড়াছুড়ি, যত রকমের হিংসা ও বিদ্বেষ আছে, সবকিছু সামনে এনে একে অপরের ওপর তুমুল বেগে ঝাপিয়ে পড়ছে।
এক পক্ষ যথারীতি ধর্মকে টেনে আনছে। ড. জাফর ইকবালের এহেন দশায় প্রকাশ্যে বা গোপনে খুশী হচ্ছে। আততায়ীকে বাহবা দিচ্ছে। অথচ ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর ২৩ বছরের নবুয়তী জীবনের কোথাও এমন একটি ঘটনাও নেই, যেখানে ইসলামের তৎকালীন কোন শক্রুর ওপর যুদ্ধ ও বিচার বহির্ভুত আক্রমনের শিকার হয়েছে। আর তা নিয়ে মদীনার মুসলিমরা উল্লাস প্রকাশ করেছেন। তবে ইসলামের নামে কেন এইসব হীনমন্যতার প্রকাশ?

ড. জাফর ইকবাল পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একজন মুসলমান। তাকে জোর করে নাস্তিক বানিয়ে দেয়ার মনে কী? যদি তিনি অবমাননা মূলক কিছু লিখে থাকেন, তার কয়েকটি কোটেশন দিন। আমরাও একটু দেখি, জানি, বুঝি, তিনি কী এমন লিখেছেন, যার জন্য তার ওপর এমন হামলা করা হবে, আর সেটা নিয়ে কিছু মানুষ উল্লাস প্রকাশ করবে! বিদ্যমান বিচারকাঠামোকে পাশ কাটিয়ে তথাকথিত নাস্তিক হত্যাযজ্ঞ সাম্প্রতিক বাংলাদেশে কোন একভাবে কিছু মানুষের কাছে বৈধতা পেয়েছে। এই রক্তাক্ত ছুরির ফলা ক্রমাগত আপনার, আমার দিকে, আপনার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

অালোচনার খাতিরে, ধরে নিলাম, ডক্টর জাফর ইকবাল খুব বড় কোন অন্যায় করে ফেলেছেন। এজন্য আল্লাহ তায়া’লা ক্বিয়ামাতের দিনে নিশ্চয়ই তার ওপর সুবিচার করবেন। তুমি কে হে নটবর, তার বিচার করার? তাছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ইসলামিী শাসনে সবচেয়ে নিরাপদ ছিলো, কী সেটা মক্কায়, কী মদীনায়, বাগদাদে কিংবা বিশ্বের যেখানেই ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কুরআনের কোন্ দলীল বা নির্দেশনার বলে সো-কল্ড নাস্তিক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণকে বৈধ করবে হে কূয়োর ব্যাঙ, মুর্খ, ধর্মান্ধ, কপট? এদের চিন্তার এহেন দীনতা সত্যিই কষ্ট দেয়, বড় বেশি পীড়া দেয়!

এমন চিন্তাকে যারা মনের মধ্যে লালন-পালন করেন, যারা এই চিন্তার পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থণ যোগান, যারা এই চিন্তার বাস্তবায়নে ধারালো তলোয়ার হাতে ভিন্নমতের ঘাড়ের কাছে তাদের বিষ নি:শ্বাস ফেলছে, তারা কেউই ইসলামের জিম্মাদার নয়। এরাই বরং ইসলামের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ। ইসলামের এদের কোন স্থান থাকতে পারে না।

যারা একজন শিক্ষকের উপর হামলাকে নানা ছলা-কলায় বাহবা দিয়ে যাচ্ছে, তাদের আদর্শ শুধু্ই ঘৃণাময়। ইসলামকে দেয়ার মতো তাদের ভান্ডারে আর কিছু অবশিষ্ঠ নেই। যারা একজন রক্তাক্ত, নির্যাতিত, মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদে উল্লসিত হয়, তাদের সঙ্গে আফ্রিকার গহীন অরণ্যের হায়েনাদের সঙ্গে কোন ফারাক নেই।
বিংশ শতকের শেষভাগে গণহত্যার শিকার বসনীয়দের নেতা ড. আলীয়া ইজ্জেত বেগোভিচ এমনই এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন,
”তোমার আদর্শে বিশ্বাসী লোকদের ভালোবাসো;
আর তোমার বিরোধী আদর্শের লোকদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করো।”

জ্ঞানতাপস মানুষটির এই শিক্ষাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা। আর তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতির নামে যা কিছু লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, করা হচ্ছে, এগুলো সব ক্ষুদ্রতা, নীচুতা, হীনমন্যতা। রহমত ও বরকতময়, উদার আল্লাহর দ্বীন ইসলামে সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই।

মুদ্রার অন্য পিঠটাও একবার উল্টে দেখি।

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ওপর নারকীয় এই হামলার পরে গত ২৪ ঘন্টায় এদের কোরাস ধ্বণিতে সামাজিক মাধ্যমগুলো আলোড়িত। সার্বিক বিবেচনায় তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে অতি কট্টর জাতীয়তাবাদী। ঘটনার পূর্বাপর বিবেচনা না করেই তারা আরেকটি গণজাগরণ মঞ্চের আয়োজনে তৎপর। তাদের বেশভূষা, কথায়-বার্তায়, চলনে-বলনে তারা সুস্থ মানুষের মতো দেখতে হলেও তাদের জ্বিহবায় লিকলিকে ঘৃণা প্রবাহমান। তাদের কলমে প্রতিটি হরফে যেন ঘৃণা আর বিভাজনের ছড়াছড়ি।
ডক্টর জাফর ইকবালের হামলাকারী ঘটনাস্থল থেকেই ধৃত। সুষ্ঠ তদন্ত হলে এর পেছনের নাটের গুরুরাও বের হয়ে আসবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা। তবে এ্মন একটি ঘৃণ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি গণহারে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, তাতে করে আর যাই হোক বিভক্তি বাড়তেই থাকবে। একই পরিবারে সহোদর, একই পাড়ার বন্ধু, একই বিদ্যায়তনের সহপাঠী, একই কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী, সবার মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা টেনে দেয়া হচ্ছে। এই অতি জাতীয়তাবাদী, তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তির এই ঘৃণার মেশিন বন্ধ না হলে দেশ ও জাতির মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

এরই মধ্যে জাতির ঘাড়ের ওপর দানবের মতো জোর-জবরদস্তি করে চেপে বসা হিরক রাজাও ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিলেন। কোনরূপ তদন্ত ও অনুসন্ধানের আগে বিজ্ঞ জহুরী, অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতো তিনি বলে দিলেন: ‘হামলাকারী কারা হামলার ধরন থেকেই স্পষ্ট’। সুতরাং, তদন্ত কোন দিকে যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য।

বর্তমান বিশ্ব সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার সামনে দাড়িয়ে, সেটা হলো কট্টর জাতীয়তাবাদ। উগ্র জাতীয় মেরুকরণ। ক্যান্সারের মতো কোশ থেকে কোশে, এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয়ে এই ঘুণা আর জাতীয়তাবাদের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। জতীয়তাবাদ মানে যারা দেশপ্রেম ভাবছেন, দেশত্ববোধকে বুঝছেন, তারা একদম ভুল বুঝছেন। এই জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে এডল্ফ হিটলার বিশ্ব যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্ব এখন আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি। এখানেও প্রধান অস্ত্র এই উগ্র জাতীয়তাবাদ। আমেরিকার ট্রাম্প থেকে রাশিয়ার পুতিন, তুর্কির এরদোগান থেকে ভারতের নরেন্দ্র মোদী, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন থেকে হাঙ্গেরীর ভিক্টর আরবান, সবার একই অস্ত্র –জাতীয়তাবাদ। ঘৃণার রাজনীতি। অর্ধশত বছর পরে যেন এডল্ফ হিটলারের পেতাত্নারা জেগে উঠেছে – প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে, পূর্ব থেকে থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। এই বিষফোঁড়াকে সমূলে উৎপাটন করতে না পারলে, ক্রমাগত ঘৃণা, ট্যাগিং, লেবেলিং আর মিথ্যাচারের জ্বালানীর মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষেরা পরস্পরের মুখোমুখী দাড়াবে। হিংস্র অন্ধ, ক্রোধান্বিত নেকড়ের মতো এক ভাই আরেক ভাইয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। রক্ত সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবে পৃথিবীর মানুষ। নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনবে।

পথ একটাই। অভিন্ন সমাধান। শান্তি!
আমাদের যার যতটুকুন সামর্থ্য আছে, শিক্ষা আছে, শক্তি আছে, সবকিছু উজাড় করে দিতে হবে। বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে হবে। নিজের অন্তরের ভেতরেই ন্যায়, নীতি ও নিষ্ঠার চাষাবাদ করতে হবে। হিংসা ও বিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রাগকে দিতে হবে চিরতরে মাটি চাপা। ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হবে অন্তর থেকে অন্তরে। সময় এসেছে আত্নসমালোচনার। আয়নার নিজের মুখটাকে দেখার, হৃদয়টাকে বোঝার। নিজেকে বোঝানোর। ভুলগুলি শোধরানোর। ভালোবাসার বীজ বুনানোর।

ভুলে যাবেন না, ঘুণা করে কেউ কোনদিন কাউকে সঠিক পথে আনতে পারেনি। শুধুমাত্র ইতিবাচকতা, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, মায়া-মমতার ছোঁয়াই পারে একজন উগ্র, গোড়া, অন্ধ মানুষকে আলোর পথ দেখাতে। আদর্শকে সুন্দরতম আদর্শ দিয়েই মোকাবেলা করতে হয়। এর কোন বিকল্প নেই, হয় না, হতে পারে না।

লেখকঃ জাহিদ আল আমীন
ফ্রাইবুর্গ, জার্মানি
মার্চ ৪, ২০১৮।

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।”

১ টি মন্তব্য
  1. Abdullah Al Manjur বলেছেন

    Seta shudhu onar khetrei na….. sobar khetrei howa uchit…. vinnonot sojjo na korar ovvash to onar netader kach thekei uni peyechen….. bolle sobar kotha bolen na hole boilen na….vondami mone hoi