অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার কাল

1
.

রাজীব সেন প্রিন্সঃ

চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের ১০৯তম বলীখেলার (কুস্তি প্রতিযোগিতা) আসর বসছে আগামীকাল ২৫ এপ্রিল বুধবার।  এ বলি খেলাকে ঘিরে গতকাল সোমবার শুরু হয়েছে ৩দিনের বৈশাখী মেলা।  বলি খেলার মঞ্চসহ সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শেষ করেছে আয়োজক কমিটি।

লালদিঘীর মাঠে এরই মধ্যে বলিদের জন্য তৈরী করা হয়েছে বিশাল রিং। আজ দুপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সার্বিক প্রস্তুতি পরিদর্শন করেছে মেলা আয়োজক কমিটি।

অন্যদিকে জব্বারের বলি খেলাকে ঘিরেই প্রতিবছরের ন্যায় এবারও লালদিঘী মাঠের আশে পাশের দেড় বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আজ থেকে বসেছে গ্রামীণ লোকজ উৎসব। যার পরিসর ছড়িয়ে পড়েছে আন্দরকিল্লা, কেসিদে রোড, কোতয়ালী মোড় পর্যন্ত। গত শনিবার থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পণ্যের পসরা নিয়ে ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠের আশে পাশে তাদের জায়গা নির্ধারণ করে নিয়েছেন।

এবার প্রতিযোগিতার ১০৯ তম আসর। ইতিমধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জন খেলায় অংশ গ্রহণের জন্য নাম লিপিবদ্ধ করেছে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতে।

ফাইল ছবি।

ঐতিহ্যবাহি জব্বারের বলি খেলার ১০৯ তম আসর:
মঞ্চে বলীদের শক্তি আর কৌশলের লড়াই। চারপাশে হাজারো দর্শকের উল্লাস। এই চিরচেনা ছবি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলি খেলার। এবারও প্রস্তুত লালদীঘি ময়দান। যেখানে বসবে, প্রতিযোগিতার ১০৯ তম আসর। ইতিমধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জন খেলায় অংশ গ্রহণের জন্য নাম লিপিবদ্ধ করেছে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতে। আয়োজকরা জানিয়েছেন শতাধিক বলি এবরাও অংশগ্রহণ করবে। গেলো বছরও ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার ১০৮ তম আসরের কক্সবাজার, টেকনাফ, রামু চকরিয়া এবং পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শতাধিক খেলোয়াড় অংশ নেন। ১০৮ তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন রামুর দিদার বলী। প্রায় ১৭ মিনিট লড়াই করে শামছু বলীকে পরাজিত করে শিরোপা জিতেন তিনি। অবশ্য এর আগের বছর ১০৭তম আসরে জব্বারের বলী খেলার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ে দিদার বলী ও টেকনাফের শামছু বলী কেউ কাউকে নির্ধারিত সময়ে হারাতে না পারায় সিলেকশন পদ্ধতিতে হেরে গিয়েছিলেন দিদার। চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলায় ১৫ বার অংশ নিয়ে ১৩ বারই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যন্য রেকর্ড গড়েছেন দিদার।

দেশপ্রেমের চেতনায় যুবকদের উদ্বুব্ধ করতে উনিশ শতকের গোড়ায় এ খেলার সূচনা করেন বনেদী ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। সেই থেকে এটা লোকসংস্কৃতিরও অংশ। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি শক্তিমত্তার লড়াইয়ে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে ১৯০৯ সালে লালদিঘী মাঠে বলি খেলার আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল জাব্বার এ বলি খেলার আয়োজন করায় তার নামেই এই বলিখেলার নামকরণ হয়ে যায়। প্রতিবছরই বাংলা বছরের ১২ বৈশাখে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলি খেলা।
নানা প্রতিকূলতার মাঝেও চট্টগ্রামের মানুষ লোকজ এ সংস্কৃতি ধরে রাখায় ব্রিটিশ ফিল্ম বিভাগ ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবে জব্বারের বলীখেলার ছবি ধারণ করে সযত্নে সংরক্ষিত রেখেছে লন্ডনের ফিল্ম আর্কাইভে।

বলিখেলাকে ঘিরে নগরীর বিশাল এলাকা জুড়ে বসেছে মাটির তৈরীর তৈজসপত্র।  ছবি- ইমরান সোহেল।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, বাঙালি সংস্কৃতি লালনের পাশাপাশি বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই ‘১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এ প্রতিযোগিতার সূচনা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর এ প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্রিটিশ ও পাকিস্থান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামিদামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। দেশ বিভাগের পূর্বে একবার এক ইংরেজ গভর্নর সস্ত্রীক আবদুল জব্বারের বলীখেলা দেখতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। আবার ১৯৬২ সালে দু’জন ফরাসি মল্লবীর আবদুল জব্বারের বলীখেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখন বিদেশ থেকে কোনো বলী না এলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শতাধিক বলি এতে অংশগ্রহণ করে।

বলিখেলাকে ঘিরে দেড় বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখি মেলা :
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহি জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে এরিমধ্যে লালদীঘি ও আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে বৈশাখী মেলা। যাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৃৎশিল্পসহ রকমারি সব জিনিসপত্র নিয়ে দোকান বসিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ নানা রঙে রঙিন হয়ে বৈশাখ হাজির হয় চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে। মেলার সময়সীমা শেষ হলেও প্রতিবছরই মেলার পণ্য বিকিকিনি চলে বাড়তি দুই একদিন।

জব্বারের বলীখেলা ও মেলাকে ঘিরে নগরজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। মেলা জড়িয়ে গেছে চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়ের সাথে। পুরো বছর অপেক্ষা করেন এখানকার গৃহিনীরা। ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার একটা বড় সুযোগ এ মেলা। নগরবাসীর মনে দেখা দেয় বাড়তি আনন্দ। দূর-দূরান্ত থেকে বলীখেলা দেখতে ও মেলায় ঘুরতে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ। তীব্র গরম ও ভিড় উপক্ষো করে সবাই ঘুরে বেড়ায় মেলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।

ছবি-ইমরান সোহেল।

দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে মেলার দু তিন দিন আগেই পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন ব্যবাসায়ীরা। তারা সড়কের দু’পাশ জুড়ে চৌকি বসিয়ে আবার কেউ মাটিতে চট বিছিয়ে সাজান মেলার পসরা। মেলার মধ্যেই কাটান তারা দিন ও রাত। এখানেই চলে খাওয়া-দাওয়া। কাটে তাদের নির্ঘুম রাতও। মাটির তৈরী নানা সামগ্রী, বাঁশ ও বেতের তৈরী মোড়া, হাতপাখা, শীতল পাটি, চেয়ার থেকে শুরু করে নানা আসবাবপত্র আনা হয়েছে মেলায়। তাছাড়া কাঠের নানা আসবাবপত্র শোভা পেয়েছে মেলায়। ফলজ, ভেষজ ও ঔষধি গাছের চারার পাশাপাশি নানা বাহারি ফুলের চারাও বিক্রি হচ্ছে মেলায়। চুড়ি, শোপিস ছাড়াও শিশুদের নানা খেলনার পাশাপাশি ফুলের ঝাড়ুর বিশাল সমাহার থাকে চোখে পড়ার মতো। অতিথি আপ্যায়নে বাঙালি অন্যরকম পারদর্শী তাই মেলাজুড়ে মুড়ি মুড়কির দোকানও রয়েছে অসংখ্য। আনন্দে মেতে ওঠার বাঙালি সংস্কৃতির অনন্য উপকরণ নাগরদোলাসহ নানা ধরনের রাইড শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে মেলার।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন জানান, দেশের কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ মেলা। নিত্যব্যবহার্য ও গৃহস্থালি পণ্যের প্রতিবছরের চাহিদা এ মেলাতেই মেটান চট্টগ্রামের গৃহিণীরা।

জব্বারের বলি খেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী জানান, বলি খেলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তারপরেও বলি খেলার মূল আয়োজন রিং পুরোপুরি তৈরী হয়ে গেছে। আয়োজক কমিটির সচিব শওকত আনোয়ার বাদল জানান, খেলা ও মেলার নিরাপত্তার জন্য বিপুল পরিমাণ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সাদা পোশাক ও ইউনিফরম পরা অসংখ্য পুলিশের পাশাপশি র‌্যাব সদস্য মোতায়েন আছে বলে জানান তিনি।