অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

ইবনে বতুতা এবং তার ভ্রমননামা

0

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ১৩০৪ সালে মরক্কোর তাঞ্জিয়ায় জন্মেছিলো এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে দেড় বছর পর মক্কা নগরীতে গমন করে তাঁর প্রথম পরিব্রাজকের যাত্রা শুরু করেন। নাম তাঁর ইবনে বতুতা । তাঁর জীবনের দীর্ঘ ২৯ টি বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে। সর্বমোট ৭৫০০০ (পঁচাত্তর হাজার) মাইল ভ্রমণ করেন তিনি। যার ফলে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন পর্যটক বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ভ্রমণ এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করাই ছিলো তাঁর নেশা এবং পেশা। তিনি একমাত্র পরিব্রাজক ছিলেন যিনি তাঁর সময়কার সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেন এবং সুলতানদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

সাল ১৩৫৪, যখন তিনি জীবনের শেষার্ধে মরক্কো ফিরে আসেন সেসময়ে তাঁর সারাজীবনের ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে বেশ চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়ে যান। সে সময়ের মরক্কোর শাসক আবু ইনান ফারিস তাঁর সফর সম্পর্কিত তথ্য নথিভুক্ত করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে অনুরোধ করেন যেনো কবি ইবনে যোজাইয়াকে সবধরনের তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন লিপিবদ্ধ করার জন্যে। সর্বশেষে তাঁর সবধরনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন এবং ওই সংরক্ষিত কাহিনীগুলোর সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় বিশ্বখ্যাত ভ্রমণ সম্পর্কিত পুস্তক ‘রিহলা’ যার অর্থ হলো ‘সফর’। ১৯৫৮ সালে এই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদও বের হয়।

ইবনে বতুতা
পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা। সেসময়ে মরক্কো ইসলাম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং তিনি একটি মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠেন এবং বিজ্ঞান, গণিত এবং ধর্মীয় শিক্ষাজ্ঞান লাভ করেন।

সময় ১৩২৫ সাল। বয়স তখন তাঁর সবেমাত্র একুশ (২১) বছর। ইতিমধ্যে তিনি হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন ইসলাম ধর্মের পবিত্র স্থান মক্কা ভ্রমণের। তিনি জানতেন এই যাত্রা অতোটা সহজসাধ্য হবে না এবং অতি দীর্ঘতর কিন্তু দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি পরিবারকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বিদায়কালটা মোটেও সুখের ছিলো না বরং তিনি উল্লেখ করেন,

“তাঁদের ছেড়ে আসার পর্বটা খুব কঠিন ছিলো, বিদায়ের সময় খুব কষ্ট হচ্ছিলো।”

মক্কায় গমন:
মক্কার রাস্তা তখনও হাজার মাইলেরও বেশি দূর। একলা বেরিয়ে পড়লেও তিনি উত্তর আফ্রিকা দিয়ে গমন করলেন কোন কাফেলার সাথে সংযুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে। কারণ ওইসময়ে যাত্রা পথ ছিলো সংকীর্ণ ও বিপদে আচ্ছন্ন, তাই আরব বেদুইনদের হাত হতে বাঁচতে এই পরিকল্পনা। যদিও কায়রোতে এক মাস অবস্থান করে মক্কার উদ্দেশ্যে নীল নদ পার হয়ে আইদাব বন্দর দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় গোষ্ঠীরা বন্দর হতে তাঁকে ফেরত যেতে বাধ্য করে। পরে কায়রোর এক সুফি শেখ আবুল হাসান আল সাদিদি’র পরামর্শে তিনি সিরিয়া দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ওইদিকে গেলে পথিমধ্যে হিব্রু, বেথেলহেম এবং জেরুজালেমের দেখা পাওয়া সম্ভব।

যাত্রাপথে তিনি তুনিশ, আলেকজান্দ্রিয়া, কায়রো, ডেমাস্কাস এবং জেরুজালেম পরিদর্শন করেন। যার কারণে স্বাভাবিকভাবে মাস ছয়েকের পথ পেরিয়ে দেড় বছর পর তিনি মক্কা নগরীর দেখা পান। ইতিমধ্যে ভ্রমণের প্রতি নিজের আনন্দ খুঁজে পান তিনি। নতুন স্থান, সংস্কৃতি এবং নতুন মানুষদের সাথে পরিচয় তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে এবং আরো দৃঢ়ভাবে মনস্থ করেন পুরো বিশ্ব চষে বেড়ানোর।

মধ্যপ্রাচ্য:
১৭ নভেম্বর, ১৩২৬ সাল। মক্কায় অবস্থানের এক মাস পূর্ণ হলো তাঁর। এবার তিনি ইরাকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন এক কাফেলার সাথে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো মদিনা যাত্রা এবং ইবনে বতুতাকে নাজাফ শহর পর্যন্ত নিয়ে যান।

এরপর টাইগ্রিস নদী পেরিয়ে বসরা এবং ওইখান হতে পারস্যের বিখ্যাত শহর ইস্পাহানের দিকে যাত্রা করেন। সেখান হতে শিরাজ শহরে গমন করেন। এরপর বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মসুল শহর ভ্রমণকালে তিনি ইলখানাতে গভর্নরের অতিথি হিসেবে ছিলেন। এরপর সিজরা এবং মারদিন শহর ভ্রমণ শেষে মক্কায় ফিরে দ্বিতীয়বার হজ্জ সম্পন্ন করেন এবং সেখানেই তিন বছর অবস্থান করেন।

আরব উপদ্বীপ, এশিয়া এবং সোমালিয়া:
তিন বছর অবস্থান শেষে পুনরায় হজ্জ সম্পন্ন করে তিনি আবার রওনা দেন ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে। লোহিত সাগরের তীর হতে ছোট একটি নৌকার সাহায্যে তিনি পৌঁছাতে সক্ষম হোন ইয়েমেনে।

ইয়েমেনের এডেন বন্দর হতে জাহাজ যোগে চার দিবস পর তিনি সোমালিয়ার জায়লা শহরে পৌঁছান।

এরপর তিনি উত্তরের দিকে ভ্রমণ শুরু করেন তুর্কি এবং ক্রিমেন পেনিনসুলা সফরের মধ্য দিয়ে। এরপর রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল সফর শেষে পূর্ব দিক হয়ে ভারতে দিয়ে যাত্রা করেন সুলতান মুহাম্মদ তুগলকের নিমন্ত্রনে। ভারতে দিল্লীর সুলতান তাঁর বিচক্ষণতা ও পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিচারক পদে নিয়োগ করেন।

কয়েক বছর কাজ করার পর তিনি সুলতানের কাছে হজ্জের অনুমতি চাইলে সুলতান তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজের কাছে রেখে দিতে চান। পরের তাঁকে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে চীনে পাঠালে তিনি কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে চাকরিতে ইস্তফা দেন এবং তিনি চীন দেশ সফরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।

১৩৪৫ সালে তিনি চীনের কুয়াংজোতে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি বেইজিং, হুয়াংজু এবং গুয়াংজু শহর পরিদর্শন করেন। সেখানে গ্র্যান্ড ক্যানেল ও গ্রেট ওয়াল অফ চায়না ঘুরে দেখেন এবং চায়নার তৎকালীন শাসক মঙ্গল খানের সাথে দেখা করেন। এরইমধ্যে তিনি শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম, বার্মা, পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এসে পৌঁছান।

১৩৪৬ সালে তিনি বাংলার সোনারগাঁ, সিলেট ও কিশোরগঞ্জের এগারসিন্দুর ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে সুন্দর ও উচ্ছ্বসিত, ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলার সুদৃশ্য শ্যামল প্রান্তর, পল্লীর ছায়া সুনিবিড় সমুজের সমারোহ সম্পর্কে তাঁর ছিলো মুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। তখনকার ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মুসলিম সুফি-দরবেশের প্রভাব, তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম। এরইমধ্যে ফুটে উঠে সোনারগাঁ এলাকার শাসক সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের আমলে বিদেশে রপ্তানি হওয়া মসলিন কাপড় সম্পর্কে বিশদ বিবরণ।

এরমধ্যে চায়নায় কয়েক বছর অবস্থান শেষে তিনি জন্মস্থান মরক্কোর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেসময়ে ইঁদুরবাহিত ‘প্লেগ’ রোগে হাজারে হাজারে মানুষ মরতে থাকলে তিনি নিজের পরিবার পরিজনের অভাব বোধ করতে লাগলেন। তিনি সে কারণেই ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে ঘরের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগে এক দূতের মাধ্যমে তাঁর পিতামাতার মৃত্যুর সংবাদ পান। তাঁরা অন্তত পনেরো বছর আগেই মারা যান ‘প্লেগ’জনিত রোগে ভুগে। সংবাদটি পাওয়ার পর তিনি ঘরে ফিরে যাওয়ার চেয়ে বরং আবার সফরের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার জন্য মনস্থির করেন। তিনি উত্তর দিক হতে আল-আন্দালুস (ইসলামিক স্পেন) এবং ওইখান হতে দক্ষিণে আফ্রিকার মধ্যমণিতে চলে যান মালি এবং আফ্রিকান বিখ্যাত শহর তিম্বুক্তু সফরের উদ্দেশ্যে।

এরপর ১৯৫৪ সাল, অবশেষে তিনি মরক্কো ফিরে আসেন এবং সেখানে শাসকের অনুরোধে তাঁর সফরগাঁথা লিপিবদ্ধ করা হয়। ১৩৬৯ সালে মৃত্যুবরণের আগ পর্যন্ত মরক্কোতে তিনি বিচারকের পদে ন্যস্ত ছিলেন।

ইবনে বতুতা পর্যটক হিসেবে মানুষের মনে বিস্ময় জাগায়। তেমনই কিছু তথ্য সংযোজিত হলোঃ

আরেক বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলোকে ইবনে বতুতার সমকক্ষ মনে করা হলেও হিসাবমতে পোলোর চেয়েও ইবনে বতুতা তিনগুণ বেশি পথ সফর করেন।
বিশ্ব ভ্রমণের ক্ষেত্রে ইবনে বতুতার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার দুই ধর্ম তপস্বী শেখ বোরহানউদ্দীন এবং শেখ মুর্শিদি।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রথমে কাবিস শহরে অবস্থানকালীন তিউনিসের এক উকিলের মেয়েকে বিয়ে করেন তবে পরে উকিলের সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে বিয়েটি টিকে নি। এরপর ত্রিপলির পরবর্তী শহর ফেজে এসে এক ছাত্রের মেয়েকে বিয়ে করেন। তাছাড়া তাঁর কয়েকজন সন্তানও ছিলো।
বিভিন্ন শহরে সফরকালীন সময়ে খন্ডকালীন ‘কাদী’ (বিচারক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ওইসব দেশে।
সফরকালে দিল্লী হতে সুলতানের দেয়া উপঢৌকন নিয়ে যাওয়ার পথে একবার তিনি ডাকাতদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছিলেন এবং আহত হোন। এ নিয়ে একটি আশ্চর্যজনক তথ্য রয়েছে। এর আগে মরক্কো এর দরবেশ তাঁকে এমন বিপদ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং বলেছিলেন দিলশাহ নামের কেউ তাঁকে সাহায্য করবে। সত্যিই দিল্লী হতে ফেরার পথে আহতাবস্থায় একজন এগিয়ে আসেন যিনি নিজেকে দিলশাহ নামে পরিচয় দেন। অবশ্য পরে দিলশাহকে অনেক খুঁজেও হদিস পান নি।
তিনি ঢাকার সোনারগাঁ এবং চট্টগ্রাম পরিদর্শন করেন।
তিনি ইবনে বতুতা ব্যতীত ‘শামস আদ-দীন’।
তিনি বিভিন্নজন হতে প্রাপ্ত উপহার এবং মুসলিম সমাজের আতিথেয়তায় জীবনযাপন করেছেন।
১৩৩২-১৩৪৬ সালে তিনি কৃষ্ণ সাগর, মধ্য এশিয়া, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, চীন এবং ১৩৪৯-১৩৫৪ সাল অবধি উত্তর আফ্রিকা, স্পেন এবং পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। সর্বমোট ৪৪ টি দেশ ভ্রমণ করেন ইবনে বতুতা।
ইবনে বতুতা অস্ট্রেলিয়া সফর করেন নিই।
তাঁর জীবনে তিনি ৭ বার হজ্জ পালন করেন।
বিশ্বের অন্যতম সুন্দর শহর বলে খ্যাত দুবাই শহরের শেখ জায়েদ রোডে “ইবনে বতুতা” নামে একটি শপিং মল রয়েছে যেখানে তাঁর যাবতকালের ভ্রমণের উপর ভিত্তি করে অভ্যন্তরের দিকটা সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।
২০০৯ সালে ‘নিনজা আসাসিনস’ নামের বিখ্যাত মুভিতে ইবনে বতুতার আদলে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন রিচার ভ্যান ওয়েডেন।
মরক্কোতে ‘ইবনে বতুতা সেন্টার’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মরক্কোর উদ্দেশ্যে ফেরার পথে মালে রাজ্যে পৌঁছালে তাঁর আগমনে মালে রাজ্যের সুলতান সুলায়মন অত্যন্ত খুশি হয়ে ঘোষণা দেন তাঁর জন্মদিনে তাঁকে চমকে দিবেন এবং চমক হিসেবে রুটি, মাংস আর দুধ পাঠান অথচ ইবনে বতুতা মনে করেছিলেন তাঁর জন্য উপহার হিসেবে স্বর্ণমুদ্রা পাঠানো হবে। এমন রসিকতায় অবশ্য ইবনে বতুতা খুবই মজা পেয়েছিলেন বলে গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইবনে বতুতা হলেন ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। আফ্রিকা হতে ভারত এবং ভারত হতে তুরস্ক পর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন কখনো হেটে, কখনো উটে করে কাফেলার সাথে আর কখনোবা নদীপথে। মৃত্যুই একমাত্র প্রতিবন্ধকতা ছিলো আবার অন্যদিকে আরেকটি পথ খুলে দিলো ইহকালের বাইরেও আরেকটি স্থানে গমনের সুবিধা।