অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

নামাজের সময় হলে চট্টগ্রামে যে মসজিদে গায়েবী আজান হতো!

1
.

পূজন সেন, বোয়ালখালীঃ
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর বুড়া মসজিদ।  প্রায় ৩শ বছর আগে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।  তবে এ মসজিদ ঠিক কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায়নি। এখানে দেশ বিদেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমাগম ঘটে বরকত, ফজিলত ও পুর্ণ্যরে আশায়। জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারাদেশের মানুষের কাছে পুণ্যময় তীর্থভুমি হিসেবে পরিচিত এ বুড়া মসজিদ।

ধারণা করা হয়, মোঘল আমলের শেষের দিকে প্রথম শনের ছাউনি দিয়ে এ মসজিদ গড়া হয়। জনশ্রুতি রয়েছে নামাজের সময় হলে এ মসজিদে গায়েবী আজান হতো। চট্টগ্রামের তৎকালিন প্রশাসক থানাদার ওয়াসিন চৌধুরী এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তাঁর দাদা শেখ নাছির উদ্দিন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের গৌড় এলাকা থেকে এ এলাকায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেছিলেন। খুব সম্ভবত শেখ নাছির উদ্দিন এলাকার মুসল্লীদের পাঞ্জাগানা নামায আদায়ের সুবিধার্থে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, ওয়াসিন চৌধুরীর পিতা একজন ইবাদত গুজার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইবাদত বন্দেগীতে এতই মশগুল থাকতেন যে, পারিপাশ্বিক অবস্থার কোন খবর রাখতেন না। তিনি বুড়ো বয়সে এ মসজিদে নামাজ যিকির আজকারে দিন রাত কাটিয়ে দিতেন। এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যেত তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনায়। তিনি এতই পরহেজগার ছিলেন যে, তাকে সবাই বুড়া হুজুর নামে ডাকত। ইবাদত করতে করতে তিনি একদিন এই মসজিদ থেকে গায়েব হয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁর কোন সন্ধান কেউ পাননি বলে কথিত আছে। তাই তাঁর নামানুসারে এটি ‘বুড়া মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সিএস জরিপে দেখা যায়, তার বসত বাড়ি, পারিবারিক কবরস্থান ও মসজিদ একই সাথে একই দাগে স্থিত রয়েছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানান, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া গ্রামে এ মসজিদের নামে প্রচুর জায়গা জমি রয়েছে। তবে উপযুক্ত কাগজ পত্রের অভাবে তা পুন:রুদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।

জানা গেছে, অল্প ক’জন মুসল্লী নামায পড়ার মত জায়গা নিয়ে শন পাতার বেড়া এবং উপরে দু’নালি শন দিয়ে মসজিদের প্রথম ঘর নির্মিত হয়। প্রতি বছর ছাউনি ও বেড়া পরিবর্তন করে ২০-২৫ বছর চলে এ মসজিদের কার্যক্রম। সে সময়ে সাপ, বাঘ ও জঙ্গলময় ছিলো এই এলাকা। ফলে বাঘের ভয়ে ও ঝোঁপ-ঝাঁড়ের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় এ মসজিদে মুসল্লীরা রাতে নামায আদায় করতে পারতেন না। নিরাপদ দুরত্বে থেকে মুসল্লীরা আযান দিয়ে চলে যেত।

পরবর্তিতে চারপাশে বাঁশের বেড়া এবং উপরে শনের ছাউনি দিয়ে ১০-১৫ হাত লম্বা ও চওড়া করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এভাবে ছিলো বহু বছর। খুব সম্ভবত ১৮৮৬ সালে বেড়া ও শনের ছাউনি ঘর ভেঙ্গে যায় প্রবল ভুমিকম্পের কারণে। ভাঙ্গা অবস্থায় জোড়া তালি দিয়ে আরো ২০-২৫ বছর চলে এ মসজিদের কার্যক্রম। পরে স্থানীয় লোকজন মাটির দেয়াল তুলে পুন:নির্মাণ করেন এ মসজিদ। এভাবে ৪-৫ বার নির্মাণ করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে মসজিদের কিয়দংশ পাকাকরণ করা হয়।

১৯৪০ সালে মসজিদের পুরাতন ভিত্তি ভেঙে নতুন করে ছাদ জমিয়ে পাকাকরণ করা হয়। এই ইমারত এখনও পর্যন্ত মসজিদের মধ্যখানে বহমান আছে। ১৯৭৪ সালে ৫-৬ শ জন মুসল্লী নামায আদায় করার ব্যবস্থা করে মসজিদ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে ২য় তলায় উন্নীত করা হয় এ মসজিদ। ১৯৭৫ সালের দিকে এ মসজিদের পাকা ভবনের গেইট নির্মিত হয়।

এ মসজিদে মোতওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, আব্দুল গণি চৌধুরী, হাফেজুর রহমান চৌধুরী, মুকলেছুর রহমান চৌধুরী, মুহাম্মদ এখলাছুর রহমান চৌধুরী, মুহাম্মদ মিয়া চৌধুরী, ব্যাংকার মুহম্মদ কামাল উদ্দীন ও প্রায় তিন বছর ধরে অফিসিয়াল মোতওয়াল্লী হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার দায়িত্ব পালন করছেন।

খতিব হিসেবে ছিলেন চরণদ্বীপ ইসলামিয়া রজভিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শতায়ু আলিম ওস্তাজুল ওলামা মাওলানা মুহম্মদ মুফতি ইদ্রিছ রেজভী (ম:)। বর্তমানে তাঁরই সুযোগ্য সন্তান মাওলানা অধ্যক্ষ শোয়েব রেজা খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন।

এ মসজিদের পাশে অবস্থিত বিশাল কবর স্থান মসজিদের মৌলিক আকর্ষণ। মসজিদ সংলগ্ন এ কবরস্থানে বহু আলেম ওলামা বুজর্গদের সমাহিত করা হয় বলে জানা যায়। ৭ তলা বিশিষ্ট মিনার মসজিদের যেমন শোভাবর্ধন করেছেন তেমনি আকাশছোয়া অবস্থানের কারণে দুর থেকে বুড়া মসজিদের অবস্থান জানান দেয়। এছাড়া সুললিত কণ্ঠে মোয়াজ্জিনের আযান শোনা যায় বহুদূর পর্যন্ত। মসজিদের সম্মুখে রয়েছে পুকুর ও শান বাঁধানো ঘাট।

প্রতি জুমাবার বহু দুর-দুরান্ত থেকে অসংখ্য মুসলীø জুমার নামাজ আদায় করতে ছুটে আসেন এ মসজিদে। বিভিন্ন নিয়ত করে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষ এখানে এসে ফয়জ বরকত হাছিল করেন। অনেকেই হাঁস মুরগি, গরু, ছাগলসহ অনেক রান্না করা খাবারও পাঠান এ মসজিদে। মসজিদের প্রয়োজন অতিরিক্ত রান্নাকরা খাবার ফকির মিসকীন ও মুসল্লীদের মাঝে বিতরণ করা হয়।

ওয়ারিশানদের পক্ষে মো. নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন, বর্তমানে মসজিদের অফিসিয়াল মোতাওয়াল্লী বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুন, স্থানীয় চেয়ারম্যান মো.মোকারমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক এ মসজিদের উন্নয়নে মেঘা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।

এ মেঘা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে প্রবেশদ্বারে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন তোড়ন, এতিমখানা, ভিতরে মহিলাদের জন্য আলাদা এবাদতখানা ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পূর্ণার্থীদের জন্য প্রার্থনা কক্ষ নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কার্যক্রম রয়েছে।

১ টি মন্তব্য