অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

কুমিরা-সন্দ্বীপ গুপ্তছড়া নৌ-রুটঃ শীতকালের ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজ দেয়া হলো বর্ষাকালে!

0
.

কেফায়েতুল্লাহ কায়সারঃ 
মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপের সাড়ে চার লাখ মানুষের যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন নৌযান। সন্দ্বীপবাসীর যাতায়াতের জন্য বর্তমানে নিরাপদ কোন নৌ যান নেই। সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম যাতায়াতের প্রধান নৌ-রুট কুমিরা-গুপ্তছড়ায় প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ হাজার মানুষ যাতায়াত করে ঝুঁকি নিয়ে। শীতকালে স্পীডবোট, লালবোট ও মালবোট দিয়ে যাতায়াত করা গেলেও বর্ষাকালে উত্তাল সাগর দিয়ে এই নৌযানে যাতায়াত করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

গুপ্তছড়া-কুমিরা নৌ-রুটে জুনের আগে প্রায় ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার বিলাশবহুল নতুন জাহাজ আসার কথা স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতাসহ বিআইডব্লিউটিসি সুত্রে এতদিন জানানো হলেও খুব শীঘ্রই আসছেনা এই নৌ-রুটে নতুন জাহাজ।

তাই এই বর্ষায় যাত্রী পারাপারের জন্য প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো, মেয়াদোত্তীর্ণ আর বার বার সাগরে বিকল হয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, লক্কর-ঝক্কর এবং দুটি ইঞ্জিনই ত্রুটিপূর্ণ সেই মরণফাঁদ এলসিটি কাজল জাহাজ দেয়া হলো গত ৬ জুন।

২০১৭ সালের শুরুতে কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ-রুটে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক যাত্রী পারাপারে আসে এল সি টি কাজল নামক জাহাজটি। অল্প কয়েকদিন চলার পর ইঞ্জিনগত ত্রুটির কারণে মেরামত করতে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাজটি। মেরামত শেষে বেশ কিছুদিন পর আবার যাত্রী পারাপারে আসে এল সি টি কাজল। কিছুদিন চলার পর আবার গত ৮ অক্টোবর, ২০১৭ সকালে ৩০৫ জন যাত্রী নিয়ে বিকল হয়ে যায় উত্তল সাগরে।

জানা যায়, অন্যদিনের মতই সেইদিনও সন্দ্বীপগামী যাত্রীরা কুমিরা ঘাটে আসেন সাগর পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। দিনটি ছিল সপ্তাহের খোলার দিন। তাই সেখানে ছিলেন অনেক পেশাজীবী। যারা সাগর পাড়ি দিয়েই সরাসরি যোগ দেবেন কর্মস্থলে।

প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ-রুটে স্পীডবোট ও মালবোট চলাচল করলেও মূলত এখানে নির্দিষ্ট কোন সময়-সূচী পালনের এসব নিয়ম নীতি নেই। যাত্রীরা তা ভালো করেই জানেন। তাই যে যার ইচ্ছা মত ঘাটে আসেন এবং ঘাট থেকে যখন যে নৌ-যান সন্দ্বীপের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সেটার মাধ্যমে তারা সন্দ্বীপের উদ্যেশ্যে রওয়ানা দেন।

গত ৮ অক্টোবর-২০১৭ তারিখ সকালে সন্দ্বীপগামী যাত্রীরা পৌছেন কুমিরা ঘাটে। সাগর উত্তাল থাকায় সকাল ৮টা পর্যন্ত কুমিরা ঘাট হতে কোন নৌ-যান সন্দ্বীপের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়নি। ৮টার পর যাত্রীদের জানানো হলো বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ এলসিটি কাজল কুমিরা থেকে একটু পরে ছেড়ে যাবে। যাত্রীরা সবাই ঘাট কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী ১৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে টিকেট নিলেন ও যথারীতি এলসিটি কাজল জাহাজটিতে উঠলেন।

এদিকে ৯.৩০ মিনিট হয়ে গেল এখনো জাহাজ যাত্রা শুরু করছেনা। এমনিতেই এই জাহাজটি এখন ফিটনেসবিহীন। উত্তাল এই সাগর চলাচলের অনুপোযোগী। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জাহাজের যাত্রী আবজাল হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন যেহেতু অনেক্ষণ ধরে জাহাজটি যাত্রা শুরু করছেনা তাই তারা কয়েকজন বিষয়টি দেখতে ও জানতে গেলেন কর্তৃপক্ষের নিকট। কেন জাহাজ ছাড়তে বিলম্ব হচ্ছে। তখন দেখা গেল চালকসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বার বার জাহাজের ইঞ্জিন রুমে ঢুকছেন আর বের হচ্ছেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ইঞ্জিন স্ট্রাট হচ্ছে না। অনেক চেষ্টার পর দেখা গেল ইঞ্জিন স্ট্রাট হয়েছে। আর জাহাজটিও যথারীতি সন্দ্বীপের উদ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জাহাজের নোঙর তুলেননি। জানতে চাইলে বলেন, ইঞ্জিনত্রুটির কারণে নোঙর তোলা যায়নি। আর এ অবস্থায় ৩০৫ জন যাত্রী নিয়ে চলতে শুরু করে জাহাজটি।

প্রায় ৩০মিনিট চলাচলের পর অনেকটা মাঝ নদীতে এসে জাহাজ এর দু’টি ইঞ্জিন এক সাথে বিকল হয়ে যায়। আর কোনভাবেই তা স্ট্রাট নিচ্ছে না।
আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় প্রচন্ড ঢেউয়ে টালমাটাল অবস্থা চলছিল জাহাজের। চারদিকে কান্নার রোল নেমে গেল। ছুটোছুটি করছিল যাত্রীরা। এদিকে নোঙর না তোলায় সাগরে জেলেদের জালের সাথে আটকে যায় নোঙর। আর কোনভাবেই ছুটছেনা জাহাজ। পরে জোয়ারের সাথে ভেসে ভেসে জাহাজটি প্রায় মিরসরাই এর কাছাকাছি চলে যায়। এর মধ্যে প্রায় ৮ ঘন্টা পার হয়ে গেল। যথাযথ কোন কর্তৃপক্ষও সেইদিন যাত্রীদের উদ্ধারে কোন উদ্ধার তৎপরতা চালাননি। আবার সাগরে ভাটা শুরু হলে বিকালে স্রোতের সাথে জাহাজটি ভেসে ভেসে বাড়বকুন্ড কেওড়া বাগানে এসে আটকে গেলে সেখান থেকে লাল বোটের মাধ্যমে যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়।

এর পর আবার মেরামতে নেওয়া হয় এস সি টি কাজল। কয় দিন পর দেওয়া হলো টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে। যাত্রার কিছুদিন পর ২৬০জন পর্যটক নিয়ে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে সাগরে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় কাজল জাহাজটির। আবার নেওয়া হলো মেরামতের জন্য। মেরামত শেষে দীর্ঘ ৯ মাস পর পুনরায় কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ-রুটে দেওয়া হলো বারবার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ এই জাহাজ।

ত্রুটিপূর্ণ এই জাহাজ বর্ষার বৈরী আবহাওয়ায় কেন দেয়া হলো জানতে চাইলে, বিআইবব্লিউটিসির ডিজিএম গোপাল চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘জাহাজটি মেরামত করা হয়েছে। এর পর যাত্রী সেবায় দেওয়া হয়েছে। আর সরকারী জাহাজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারী জাহাজ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই’। এলসিটি কাজল সংক্রান্ত আরো বিস্তারিত জানতে বিআইডব্লিউটিসির বর্তমান কমিশন এজেন্ট নারায়নগঞ্জের ব্যবসায়ী ‘দি বেঙ্গল ট্যুরিজমে’র স্বত্বাধিকারী সঞ্জয় কুমার রায় এর সাথে বারবার যোগাযোগ করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

এভাবে বারবার যাত্রী নিয়ে সাগরে বিকল হয়ে যাওয়া এলসিটি কাজল বর্ষাকালে উত্তাল সাগরে কুমিরা-গুপ্তছড়ায় যাত্রী পারাপারের জন্য কতটুকু উপযোগী তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে জাহাজটির মাধ্যমে ঈদে ঘরমুখো মানুষগুলো নাড়ির টানে বাড়িতে যাতায়াত করলেও নিরাপদ যাতায়াত নিয়ে বেশ শংসয়ে আছে সন্দ্বীপবাসী।

লেখক-কেফায়েতুল্লাহ কায়সার
নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক উপনগর
প্রিন্সিপাল, ন্যাশনাল গ্রামার স্কুল
এ-ব্লক, হালিশহর, চট্টগ্রাম।

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।”