অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

সারাদেশে ছাত্রলীগ আতংকে শিক্ষার্থীরা, উদ্ধিগ্ন অভিভাবক মহল

0

আব্দুল্লাহ আল জামিলঃ

.

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় অস্থিরতা বিরাজ করছে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। প্রচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা, প্রাণনাশ ও গুম করার হুমকিতে এক ধরণের আতংক বিরাজ করছে।

ছাত্রলীগের প্রতিনিয়ত হামলা ও পুলিশী হয়রানির কারনে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্ধিগ্ন হয়ে পড়ছে অভিভাবক মহল। অনেক অভিভাবক সন্তানদের ক্যাম্পাস থেকে বাড়ী নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আবার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের সাময়িক যেতে বারন করছেন। সব মিলিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরাজ করছে ছাত্রলীগ আতংক।

গত (৩০ জুন) শনিবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের হামলায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের শীর্ষ নেতা নুরুল হক নুরসহ একাধিক শিক্ষার্থী গুরতর আহত হয়। একই দিন রাতে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঠে নামলেই মারধর ও গুম করা হবে এই বলে হুমকি দিয়েছে ইসলামী বিশ্বববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।  ইবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা হালিম প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়।

.

গত রবিবার থেকেই ঢাকার শাহবাগে থাকা তরুণদের মোবাইল ফোন চেক করে ফেসবুকে সন্দেহজনক কিছু পেলেই মারধর করে তাদের থানায় দিচ্ছে ছাত্রলীগ। রবিবার (১জুন) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোটা সংস্কার আন্দোনকারীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সেখানে বেশকয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হয়।

গত (২জুলাই) সোমবার কোটা সংস্কার আন্দোলকারীদের উপর হামলার প্রতিবাদ জানাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। একই দিন ‘পতাকা মিছিল’ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহবায়ক শাকিলুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে আন্দোলনের আরেক কর্মী রাজিব আহমেদকে চড়-থাপ্পড় দেয়া হয়।

সোমবার বিকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালিয়ে চার শিক্ষার্থীকে আহত করা হয়। এদের মধ্যে রাবি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তরিকুলকে হাতুড়ি পেটা করে তার মেরুদন্ডের হাড় ও পা ভেঙ্গে দেয়া হয়। রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ নুরুর নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়।

এরপর বুধবার কোটা সংস্কারের দাবিতে সক্রিয় আন্দোলনকারী শেখ জসিম উদ্দিন বিজয় নামে এক ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করেছে রাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

গত সোমবার ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে একটি কর্মসূচীতে অংশ নিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সেখানে ফারুক নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। ফারুক বাঁচাতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী মরিয়ম মান্নান।

.

গত বৃহস্পতিবার (৫ জুলাই) কোটা আন্দোলন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মির্জা ফখরুল ও এস এম মেহেদী হাসানকে মারধর করেছে ছাত্রলীগ।

গত (১জুলাই রবিবার) চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলোশহরে কোটা আন্দলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে ৫জন সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়।

রাবি ছাত্রলীগের হামলায় গুরতর আহত তরিকুলের ছোট বোন ফাতেমা খাতুন বলেন, আমার বাবা কৃষক। মাঠে জমি-জমাও নেই আমাদের। তিন ভাই-বোন সবাই পড়াশোনা করি। বাবা-মা কষ্ট করে আমাদের পড়াচ্ছিলেন। মাসে তরিকুল ভাইয়ের জন্য হয়তো তিন/সাড়ে তিন হাজার টাকা পাঠাতেন। অথচ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য এখন প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। এত টাকা আমরা কোথায় পাব?

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। জোট নেতারা বলেন, গত ৩০ জুন থেকে ৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা-আক্রমণ করেছে। একই সঙ্গে পুলিশের হয়রানি, গ্রেফতার ও ৫৪ ধারায় তুলে নিয়ে যাওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।

জোট নেতারা অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোতে লাটিসোটা, রড, চাপাতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর শারিরীক আক্রমণ-নিপীড়ন মারপিট করে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে।

সোয়ানুর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, আমরা কোন দল ও সরকারের বিরুদ্ধে নই। আমরা অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছি। ছাত্রলীগ কেন আমাদের আন্দোলনের বিরোধীতা করছে ও তারা কেন আমাদের মারধর করছে আমরা বিছুই জানিনা। তারা যেমন ছাত্র আমরাও ছাত্র। তাদের উচিত ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন প্রতিহত নয় সহযোগিতা করা।

নুসরাত জাহান নামে আরেক ঢাবি শিক্ষার্থী বলেন, কোন অপশক্তিই আমাদের আন্দোলন দমাতে পারবেনা। আমরা শুধু আমাদের চাকরি ও জীবনের নিশ্চয়তা চাচ্ছি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র রাকিবুল বলেন, এক সময় আমি নিজেই ছাত্রলীগ করতাম। এখন ছাত্রলীগের নাম শুনলেই শরীর শিউরে উঠে। মনে হয় এই বুঝি ছাত্রলীগ এসে মারধর করে পুলিশে তুলে দিলো। আমরা অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এখন চরম জীবন ঝুঁকিতে আছি।

এবিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বায়োকেমেস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান পাঠক ডট নিউজকে বলেন, কোট সংস্কার আন্দোলন এটা ছাত্রদের নৈতিক অধিকার। এ বিষয়ে সরকারের কোন বক্তব্য থাকলে তারা সেটা দিবে কিন্তু ছাত্রনামধারী কোন সংগঠনকে এমন কোন লাইসেন্স দেওয়া হয় নাই বা দেওয়া উচিত নয় যে তারা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের পেটাবে। তারা ছাত্রদলের পায়ের তলায় পিষ্ট করবে ছাত্রীদের লাঞ্চিত করবে। ছাত্র নামধারীদের এই নৈরাজ্য এটা আমাদের জন্য বেশি লজ্জার কারন আমাদের ছাত্রদেরকে আমরা রক্ষা করতে পারছিনা। আমার কাছে সব ছাত্রই সমান। আমাদের চোখের সামনে একদল ছাত্র আরেক দল ছাত্রকে পেটাচ্ছে। আমরা ক্যাম্পাসে ছাত্রদের নিরাপত্তা দিতে পারছিনা এটা সত্যি আমাদের জন্য হতাশার বিষয় কারন আমরা ছাত্রদের কি শিক্ষা দিচ্ছি।তারা যদি লেখাপড়ার পরিবর্তে হাতে হাতুড়ি তুলে নিচ্ছে। দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে এই ধরণের নৈরাজ্য বন্ধ হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।