অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

আমি মূর্খ, তাই বলে তুমি জ্ঞানপাপী হবে!

1
মাহবুবা সুলতানা শিউলি

ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার কারণে কারো মৃত্যু ঘটলে, সাধারণ জনগণ যখন প্রতিবাদ করে তখন এদেশের জ্ঞানী! ডাক্তাররা আমাদের মূর্খ বলে অপমান করে। ডাক্তারদের কথামতে ধরা যাক! আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ। আমাদের জ্ঞানের অভাব তাই আমরা আপনাদের মতো ডাক্তারি পড়ে জ্ঞানী হতে পারিনি। তাই আমরা মূর্খ! এখনও বিশ্বাস করি দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের একটি অংশ চিকিৎসা পেশায় প্রবেশের সুযোগ পায়। সাধারণ জনগণ আল্লাহর পর রোগীর সংকটের মুহূর্তে ডাক্তারকেই দ্বিতীয় ঈশ্বর হিসেবে ভেবে থাকেন পরম বিশ্বাসে। কারণ ডাক্তারের প্রতি রোগীর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস থাকে । একজন রোগীর করুণ মুহুর্ততে চিকিৎসা ছাড়া আর করার কিছুই থাকে না। এসময় ডাক্তার এবং নার্সদের একটু সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও একটু ভালো ব্যবহার পেলে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়, বাকী অর্ধেক সুস্থতা নিয়মমাফিক সঠিকভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ওপর নির্ভর করে।

কিন্তু এ জ্ঞানীরা যখন জ্ঞানপাপীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হন, দায়িত্বে অবহেলা করে ভুল চিকিৎসা করেন আর তাদের অবহেলার কারণে আমরা যখন প্রতিবাদ করি তখন আমরা মূর্খ হয়ে যাই, জ্ঞান নেই বলে অপবাদ ছড়ায়। আর কতিপয় জ্ঞানপাপীরা ‘তাদের হয়রানি করা হচ্ছে’ বলেও উল্টো অভিযোগ করেন। এর প্রতিবাদে পালন করেন কর্মবিরতি। আর এভাবে জিম্মি করে রাখেন আমাদের মত অসহায় মানুষদের। আমরা বিশ্বাস করি, কোনো রোগীকে জিম্মি করে দাবি আদায় করা কখনও চিকিৎসকদের কাজ হতে পারে না। নিজের চরম সংকটের মুহুর্তেও আগে রোগীর সেবাপ্রদান করাই ডাক্তারের ধর্ম হওয়া উচিৎ, এমনকি তার চরম শত্রুকেও। অথচ এখন হচ্ছে তার উল্টো।

.

আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কম সময়ের মধ্যে বেশি রোগী দেখার কারণে তাড়াহুড়া করে ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন চিকৎসকরা। মন দিয়ে রোগীর কথা শুনছেন না বা রোগীর কথা শেষ হবার আগেই প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ হয়ে যায়। একইসময়ে একসাথে তিন-চারজন রোগীকে কক্ষে ঢুকিয়ে একজনের সামনে অপরজনদের চিকিৎসা দেন যেখানে রোগীর প্রাইভেসির কোন মূল্য দেবার প্রয়োজনবোধ করেন না। একজন মানুষ তার সমস্যার সকল সিক্রেট বিষয় ডাক্তারের সাথে শেয়ার করতে চান কিন্তু বড় বড় ডাক্তাররা যদি এভাবে চিকিৎসা করান তবে মূল্যবোধ সম্পন্ন রোগী দ্বিতীয়বার সে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধ্য।

তাছাড়া অপারেশন কন্ডিশনের রোগী পেলে মহাখুশী প্রাইভেট ক্লিনিকের চিকিৎসকরা। এ ধরণের রোগী পেলে চিকিৎসকরা এমনভাবে ভয় দেখায় যে, ডাক্তারের কথা শুনে রোগী এবং রোগীর অভিভাবকরা শুরুতেই ভীত হয়ে পড়েন। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। যদিও একজন চিকিৎসক এভাবে ভীতি দেখিয়ে রোগীকে হতাশ করতে পারেননা। তারা বলে, দ্রুত অপারেশন না করালে রোগীর খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। কোনরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়েই দ্রুত অপারেশনটা করাতে পারলে কামাইটা ঝামেলাহীনভাবে করা যায় । এখানে রোগী বাঁচলো না মরলো সেটা চিকিৎসকদের কাছে মুখ্য নয়। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক হাসপাতালে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পদ্ধতি চালু নেই। ফলে ডাক্তাররা প্রতিদিন গড়ে ৯০-১০০ জন রোগী দেখে থাকেন। শুধু তাই নয়, পুনরায় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট পরিমাণ ফি আদায় করেন। পাশাপাশি রোগীদের সাথে ডাক্তারদের দুর্ব্যবহার এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, এটা তাদের একটা বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এভাবে রোগীদের অবহেলা করে তারা শুধু চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন না, এতে করে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে প্রচন্ডভাবে আস্থার সংকট তৈরি করছেন। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এসব ডাক্তারের গ্রহণযোগ্যতাও।

যুক্তরাজ্যের ১৭০ বছরের পুরনো মেডিকেল জার্নাল ‘বিএমজে’ গতবছর শেষ নাগাদ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে একজন ডাক্তার গড়ে ৪৮ সেকেন্ড রোগীর জন্য সময় দেন। যেখানে উন্নত বিশ্ব সুইডেন, নরওয়ে, আমেরিকার ডাক্তাররা গড়ে প্রায় ২০ মিনিট করে সময় দিচ্ছেন। অথচ রোগের চিকিৎসাক্ষেত্রে, ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সবচেয়ে বেশি থাকা প্রয়োজন।

আমাদের বিশ্বাস, কোনো ডাক্তারই চাননা তার রোগী মারা যাক, রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করাটাই একজন চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব। তাই একজন ডাক্তার কোন ইনজেকশন পুশ করার আগে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে রোগী বা স্বজনদের অবহিত করবেন। রোগীর সাথে বুঝাপড়া করা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কেননা একই ইনজেকশনে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠতে পারে আবার মারাও যেতে পারে। কারণ এধরণের জটিল চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের দায় রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বললে বলতে হবে অপারেশনের সময় রোগীর বা স্বজনের কাছে থেকে স্বাক্ষর নিতে হয়, এসময় রোগী মারা গেলে চিকিৎসক দায়ী থাকবেন না। আর একজন ভালো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা হওয়া উচিৎ সেরকমই। কেননা চিকিৎসা বা চিকিৎসকের ভুল ছাড়াও অনেকসময় দেখা যায়, ভেজাল ওষুধের ফলে রোগী মারা গেছেন। কারণ আমাদের দেশে ২০ ভাগ ওষুধই হচ্ছে ভেজাল। আরেকটি জরুরি বিষয়, আইনে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসার জন্য কোনো পানিশমেন্ট নেই, কিন্তু অবহেলার জন্য পানিশমেন্ট আছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক বর্তমান সময়ে।

যেকোনো ভুল চিকিৎসা প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চোর-ডাকাত-অপরাধীরা যেভাবে শাস্তি পায়, ভুল চিকিৎসার জন্য দায়ী ডাক্তারকেও সমানভাবে শাস্তি পেতে হবে। পাশাপাশি লাইসেন্সহীন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোর বিষয়ে প্রশাসনকে সোচ্চার থাকতে হবে। এ মৃত্যুকূপ গুলোর বিষয়ে সচেতন না হলে সেখানে শুধু ডাক্তারদের দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। এধরণের ভুল-ভ্রান্তিগুলো সংশোধন করলে এদেশের মানুষের চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে এবং রোগীদের দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে না। আর আমাদের রাজস্বও হারিয়ে যাবে না। কেউ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন প্রতিবাদ করতেই পারে, সাংবাদিক কন্যা রাইফার অকাল মৃত্যুতে সবাই প্রতিবাদ করাতে ঐ হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ অভিযানের প্রতিবাদে বৃহত্তর চট্টগ্রামে সব বেসরকারি হাসপাতালে অনির্দিষ্টকালের জন্য হাসপাতাল সেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন প্রাইভেট ক্লিনিকের মালিকরা। যা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। ডাক্তারদের মতো উঁচু মানের পেশার ব্যক্তিরা এত অসহনশীল আচরণ করলে মানুষ যাবে কোথায় যাবে। অসুস্থ একজন রোগী তার চরম মুহুর্তে একটু সুন্দর ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন।

চট্টগ্রাম তথা দেশবাসী সাংবাদিক কন্যার মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি। তাই জোরালো আন্দোলন হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে। ভুল মানুষেরই হয়। ডাক্তাররাও মানুষ কিন্তু আজ কিছু চিকিৎসক আজ দানবের ভুমিকা পালন করছে। এসব দানব চিকিৎসকরা ভুল স্বীকার কিংবা ক্ষমা না চেয়ে উল্টো সাধারণ মানুষদের মূর্খ বলছে। যা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবাদিক কন্যার মৃত্যুতে পরিচিত, অপরিচিত কোনো ডাক্তারকে অনুশোচনা করতে দেখিনি। কেউ সাহস করে বলেনি, আমরাও রাইফার অকাল মৃত্যুর বিচার চাই। আমরা যদি দোষী হই অবশ্যই আমাদের শাস্তি পাওয়া উচিৎ। এ কথাটি কোন চিকিৎসক বলেনি ।

উল্টো আজ তারা সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। মানুষকে জিম্মি করে দাবী আদায়ের কোনো কর্মসূচি চিকিৎসকদের কাছ থেকে কাম্য নয়। এ ধরনের কর্মসূচী সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সাংবাদিক কন্যার মৃত্যুর পর কোন ডাক্তার বলেনি যে, আমরাও তো মানুষ, আমাদেরও ভুল হতে পারে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যারা অপরাধী তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু তা না করে উল্টো হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। ওরা কি ভুলে গেছে, ওদের শপথ বাক্য! চিকিৎসা পাওয়া সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, এটা ব্যাহত হলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রাষ্ট্র সংরক্ষণ করে। সেটা কি এই জ্ঞান পাপীরা ভুলে গেছে! পরিশেষে, আমরা দাবি জানাই, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু বরণকারী সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যুর জন্য চিহ্নিত ও তদন্ত রিপোর্টে যেসব দোষী চিকিৎসকদের নাম এসেছে, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

 

লেখকঃ-মাহবুবা সুলতানা শিউলি
সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ,
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

mahbubasheuly82@gmail.com

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।  তাই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক ডট নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।
১ টি মন্তব্য
  1. Ibhm Moham বলেছেন

    ধন্যবাদ আপু