স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী ৪৫ প্রাণের স্বপ্ন
মীরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধিঃ
দেখতে দেখতে ৭ পূর্ণ হলো মীরসরাই ট্র্যাজেডী। এখনো ৪৫ ছাত্রের স্বজনের বুকফাটা আহজারীতে আবুতোরাবের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। চোখের জল শুকিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছে অকালে সন্তান হারা স্বজনদের। গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে আদরের সন্তানকে খুঁজে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকেন অভাগীনি মা। গভীর রাতে ভেসে আসে কান্নার রোল। স্মৃতি বলতে শুধুমাত্র ছবির ফ্রেমই রয়েছে। পুত্রহারা পিতা-মাতারা সেই ছবি নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে আহজারী করতে থাকেন। আবার কখনো কখনো নীরব নিস্তব্ধ হয়ে একেবারেই নির্বাক।
ট্র্যাজেডীতে নিহতদের বাড়িতে এক হৃদয় বিদায়ক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। আদরের সন্তানের স্মৃতি যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তারা। সান্তনা দিতে ছুটে যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সহ বিদেশী প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
আজ ১১ জুলাই মীরসরাই ট্র্যাজেডীর ৭ বছর পূর্তি। সন্তান জন্ম নেয়ার পর অনেক বাবা-মা তাদের আদরের সন্তানের জন্ম দিন পালন করে থাকেন। কাটা হয় কেক। আয়োজন করা হয় হয়ে থাকে রকমারির খাবারের। কিন্তু কোন মা-বাবা কি আদরের সন্তানের মৃত্যু বার্ষিকী পালন করতে পারে!।
২০১১ সালের ১১ জুলাই মীরসরাইয়ে ঘটেছিলো তেমনি একটি ঝড়। যে ঝড় কেড়ে নেয় ৪৫টি তাজা প্রাণ। ঝড়ের কবলে পড়ে পিতার কাধে উঠেছিল আদরের সন্তানের লাশ। ট্র্যাজেডীতে নিহতদের বাড়িতে স্বজনদের খোঁজ খবর নিতে গিয়ে এক হৃদয় বিদায়ক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। আদরের সন্তানের স্মৃতি যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তারা। ট্র্যাজেডীতে নিহত আনন্দ দাস, সাইদুল, নয়ণশীল, ইফতেখার, কামরুলের হতভাগীনী মায়েরা সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে এখনো পথ চেয়ে থাকেন, ছেলে বাড়ি ফিরবে মা বলে ডাকবে এ আশায়।
মীরসরাই ট্র্যাজেডির ৭ বছরের পূর্ণ হওয়ায় স্মৃতিচারন করতে গিয়ে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক বলেন, দুর্ঘটনায় আমাদের স্কুলের ৩৪ জন ছাত্র মারা গেছে। তাদের শূন্যতা কখনো পূরন হবার নয়। এখনো মনে হচ্ছে তারা আমার আশেপাশে ঘুরাফেরা করছে। বিশেষ করে আবু সুফিয়ান, ধ্রুব নাথ ও কাজল নাথকে আমার খুব বেশি মনে পড়ছে। এরা তিনজনই খুব মিধাবী ছিল।
বিভীষিকাময় সেদিনে যা ঘটেছিল ঃ
১১ জুলাই ২০১১, সোমবার মীরসরাই স্টেডিয়াম থেকে ফিরছিল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলা শেষে একটি মিনি ট্রাকে করে বিজয়ী এবং বিজিত উভয় দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা আবুতোরাব এলাকায় যাচ্ছিল। বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের সৈদালী এলাকায় ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ডোবায় উল্টে যায় মিনিট্রাকটি। যার নং চট্টমেট্রো – ড – ১১-০৩৩৭। ডোবার জল থেকে একে একে উঠে আসে লাশ আর লাশ। পরে সে লাশের রথ গিয়ে থামে পঁয়তাল্লিশে গিয়ে। অপর দিকে ছেলের মৃত্যু হয়েছে ভেবে হৃদ ক্রিয়া বদ্ধ হয়ে মারা গেলেন এক বাবা হরনাথ। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর রাত ৯ টায় নয়নশীলের প্রয়ান পর্যন্ত ৪৫টি মৃত্যু গুনতে হয়। সব মিলিয়ে ৪৫ জনের প্রাণের বিনিময়ে রচিত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডী।
আবুতোরাব বহু মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৩ শিক্ষার্থী মিরসরাই ট্র্যজেডীতে প্রাণ হারায়। এ ছাড়া আবুতোরাব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩, প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের ২, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার ২, এবং আবুতোরাব এস এম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২ জন শিক্ষার্থী মারা যায় এই দুর্ঘটনায়। মিররসরাই ট্র্যাডেজীর ঘটনায় নিহতরা হলো সাইদুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, তাকিব উল্লাহ মাহমুদ সাকিব, আনন্দ চন্দ্র দাশ, নুর মোহাম্মদ রাহাত, আল মোবারক জুয়েল, তোফাজ্জল ইসলাম, লিটন চন্দ্র দাশ, মোঃ সামছুদ্দিন, মেজবাহ উদ্দিন, ইমরান হোসেন ইমন, কাজল চন্দ্র নাথ, সূর্য চন্দ্র নাথ, ধ্রুব নাথ, আবু সুফিয়ান সুজন, রুপন চন্দ্র নাথ, সামছুদ্দিন, ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আমিন শরীফ, উজ্জল চন্দ্র নাথ, শরীফ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন, কামরুল ইসলাম, তারেক হোসেন, নয়ন শীল, সাজু কুমার দাশ, জুয়েল বড়–য়া, রায়হান উদ্দিন, জাহেদুল ইসলাম, এস এম রিয়াজ উদ্দিন, টিটু দাশ, রাজিব হোসেন, আশরাফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, জাহেদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, আশরাফ উদ্দিন পনির, রায়হান উদ্দিন শুভ, মঞ্জুর মোর্শেদ, তারেক হোসেন, সাখাওয়াত হোসেন নয়ন, আনোয়ার হোসেন, হরনাথ দাশ, আরিফুল ইসলাম, রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী।