অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

ফটিকছড়িতে হতদরিদ্রদের ৪০ দিনের কর্মসুচী প্রকল্পের কোটি টাকা লোপাট

0
.

প্রধান শিক্ষক, যুবলীগ ছাত্রলীগ নেতা, মৃত গ্রাম পুলিশকে শ্রমিক দেখিয়ে সোয়া কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ফটিকছড়িতে হতদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসুচী (ইজপিপি) প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নে ২০১৫-২০১৬ এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের প্রকল্পে এ অনিয়মের অভিযোগ উঠে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষি ব্যাংক ম্যানেজারের যোগসাজসে প্রকল্পে দুই অর্থ বছরে ১ কোটি ১৫ লক্ষ ২০
হাজার টাকা লোপাটের কথা জানান স্থানীয়রা।  এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা শহিদুল আলম বাদী হয়ে এ অভিযোগ দুটি দায়ের করেন।

প্রকল্প বাস্তবায়নে দৈনিক শ্রমিক হিসেবে অতিদরিদ্রদের স্থলে শ্রমিকের তালিকায় রয়েছে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি, এলাকার
প্রবাসী, পল্লি চিকিৎসক, মৃত ব্যক্তি , ইউনিয়নের চৌকিদার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করনিক।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান সরকার রুপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুর্ভিক্ষ এবং মঙ্গা মোকাবেলার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় অতিদরিদ্র মানুষ যাতে অভুক্ত না থাকে সে জন্য ৪০ দিনের এ কর্মসুচী গ্রহন করেন।  দুর্ভিক্ষ এবং মঙ্গাকালীন সময়ে বিভিন্ন জেলার হতদরিদ্র লোকজন ইজিপিপি কর্মসুচীর আওতায় ৪০ দিন ধরে কাজের বিনিময়ে অর্থ পাবে। ফলে দেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্ভিক্ষ আর মঙ্গার প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে।
সরকারের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নে ২০১৫-২০১৬ এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ব্যাপক নয় ছয় করা হয়েছে।
এ দুই অর্থ বছরে ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা করে ৪ বার ১ কোটি ১৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকার প্রকল্প বরাদ্ধ করে সরকার। এ প্রকল্পে বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, খাল-ছড়া, ভেড়ী বাঁধ সংষ্কার করার কথা। ইউনিয়নের কিছু কিছু এলাকায় নাম মাত্র কাজ করা হলেও দুই অর্থ বছরে প্রকল্পের বরাদ্দ হওয়া প্রায় সোয়া কোটি টাকার সিংহভাগ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

প্রকল্পের কাজে স্থানীয় হতদরিদ্র লোকজনকে দিয়ে কাজ করানোর নিয়ম থাকলেও এ ইউনিয়নে নিয়মের ব্যাপক ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়েছে। ইউনিয়নের দুই অর্থ বছরের প্রকল্প বাস্তবায়নের যে তালিকা তাতে এসব অনিয়ম উঠে এসছে। মাটির কাজের দৈনিক শ্রমিক হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তা রীতিমত চমকে উঠার মত।

স্থানীয় কৃষি ব্যাংক হেয়াকোঁ শাখায় শত শত একাউন্ট খোলে প্রকল্পের এসব টাকা উত্তোলন করেছে চেয়ারম্যান জানে আলম। শ্রমিক হিসেবে যাদের নামে একাউন্ট খোলা হয়েছে তাদের বেশীর ভাগই শ্রমিক শ্রেনীর লোক নন। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড এলাকায় শ্রমিক হিসেবে দেখানো হয়েছে বালুটিলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ জামাল মজুমদারকে যার হিসাব নং-১০৬৫৬। বাগান বাজার ইউনিয়নের গজারিয়া জেবুন্নেছা পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোমিন মজুমদার যার হিসাব নং-১০৬৫৭।

দাঁতমারা ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি আবদুল শুক্কুল যার হিসাব নং-১০৬৮১। জিলতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মৃত লোকমান হোসেন যার একাউন্ট নম্বর ১০৬৮২। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে প্রবাসী ফাহাদ আলী হিসাব নম্বর-১০৬৮৮ ।

৮ নং ওয়ার্ডে শ্রমিকের তালিকায় রয়েছেন স্বয়ং চেয়ারম্যানের শ্যালক ব্যবসায়ী জাহেদুল আলম হিসাব নম্বর ১১৫৭৯। বর্তমানে গ্রামীন ব্যাংকের চাকুরীজীবি মাহবুবুল আলম যার হিসাব নম্বর-১০৭২১। প্রবাসী আবদুর রহিম হিসাব নম্বর ১১২৯৪, প্রবাসী ইউছুফ খান হিসাব নম্বর-৮৫৫৬ ।

যুবলীগ নেতা লোকমান হিসাব নম্বর ৮৫৬৮।  যুবদল নেতা ও সাবেক মহিলার মেম্বারের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম যার হিসাব নম্বর ১১২৬২।  ছাত্রলীগ নেতা আবু ইউছুফ হিসাব নম্বর ১১২৬৩, যুবলীগ নেতা তৈয়বুল হক হিসাব নম্বর ১১৫৭৭।

এছাড়া রয়েছে হেয়াকোঁ বনানী স্কুলের অফিস সহকারী মো. রুবেল হিসাব নম্বর ১১২৬৪ ও দাঁতমারা মাদ্রাসার অফিস সহকারী নাসির উদ্দিন হিসাব নম্বর ১১৫৮০।

চমকে দেয়া এ শ্রমিক তালিকায় রয়েছে সালাউদ্দিন সাজিব নামের এক পুলিশ কনস্টেবল যার হিসাব নম্বর ১১২৮৭ । পল্লি চিকিৎসক নুরুল আবছার হিসাব নম্বর ১১২৮৪।

এছাড়া শ্রমিকের তালিকায় রয়েছে ইউনিয়নের মৃত চৌকিদার জামাল উদ্দিন হিসাব নম্বর ১১২৫৭। বর্তমানে কর্মরত চৌকিদার নুরুল ইসলাম-১১২৫৮, আবদুচ ছালাম-১১২৫৯ ও সুজল হক -১১২৬০।  এসব ব্যক্তিদেরকে শ্রমিক হিসেবে ২০১৫-২০১৬ এবং ২০১৬-২০১৭ উভয় অর্থ বছরেই দেখানো হয় এবং তাদের নামে ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকাও উত্তোলন করা হয়।

এছাড়া যে সব ওয়ার্ডে এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে সে সব ওয়ার্ডে এধরনের আরো অগনিত শ্রমিক রয়েছে যারা প্রকৃত পক্ষে পেশাদার শ্রমিক এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠি নন।

স্থানীয় কৃষি ব্যাংক হেয়াকোঁ শাখার ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান ও উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম’র পরস্পর যোগসাজসে চেয়ারম্যান জানে আলম সরকারী এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে কথিত শ্রমিক বাগান বাজার ইউনিয়নের গজারিয়া জেবুন্নেছা পাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোমিন মজুমদার বলেন, তিনি কেন শ্রমিক হবেন ? তার ছবি কোথাও থেকে সংগ্রহ করে স্বাক্ষর জাল করার পর এ অনিয়ম করা হয়েছে। বিষয়টি তিনি জানেনা বলে মন্তব্য করেন।

চেয়ারম্যান এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের পুরুষ এবং নারী ইউপি সদস্যদেরকে প্রকল্প কমিটির সভাপতি করলেও তা ছিল কেবল অফিসিয়াল ফরমালিটি। বাস্তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদেরকে রাখা হয়েছে অনেকটা অন্ধকারে। প্রকল্প দেয়ার সময় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যদেরকে অবহিত করলেও এর পর কাজ করা এবং টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে তাদেরকে আর কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত টাকার এক ভাগ শুধু তাদেরকে কাজ করার জন্য ক্ষেত্র বিশেষে দেয়া হলেও সিংহভাগ টাকা চেয়ারম্যান নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন।

আবার কোন কোন ওয়ার্ডে নিজের অনুগত নারী ইউপি সদস্যদেরকে বেশী ব্যবহার করেছেন এ অনিয়মের কাজে। প্রকল্পে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিকে শ্রমিক দেখিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের ফলে প্রকৃত শ্রমিক এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠি সরকারের এ প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবী স্থানীয়দের।

ইউনিয়নের ১ বালুটিলা ওয়ার্ডে সদস্য ইউছুফ আলী বলেন ইউছুপ আলী, ২ নং ওয়ার্ডেও ইউপি সদস্য নবীর হোসেন, ৩নং ওয়ার্ডের সুব্রত ও মহিলা সদস্য হালিমা বেগম পাখি’র সাথে আলাপকালে তাঁরা জানান, চেয়ারম্যান এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের পুরুষ এবং নারী সদস্যদেরকে প্রকল্প কমিটির সভাপতি করলেও তা ছিল কেবল অফিসিয়াল ফরমালিটি। বাস্তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদেরকে রাখা হয়েছে অনেকটা অন্ধকারে। তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন ও টাকা উত্তোলনের কাজ করেছে চেয়ারম্যান
জানে আলম নিজেই।

৮ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সেক্রেটারী আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকল্পে তিনি সভাপতি ছিলেন কাগজে কলমে। বাস্তবে প্রকল্পে দুই অর্থ বছরে মোট কত টাকা তাঁর ওয়ার্ডে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা তিনি জানেনা। এ ছাড়া বরাদ্দকৃত টাকার কিয়দাংশ তাঁকে ক্ষেত্র বিশেষে কাজ করার জন্য দেয়া হলেও সিংহভাগ অর্থ দেয়া হয়নি। তিনি বলেন যে সব ব্যক্তিকে শ্রমিক হিসেবে তালিকা দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে তারা প্রকৃত পক্ষে শ্রমিক নন। চেয়ারম্যান নিজের ক্ষমতাবলে এ তালিকা তৈরি করে ব্যাংক কর্মকর্তার সহযোগিতায়।

কৃষি ব্যাংক হেয়াকোর শাখা ব্যবস্থাপক মো. আজিজুর রহমান (সদ্য ফটিকছড়ি শাখায় বদলীকৃত) মুঠোফোনে জানান, কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমিকের ব্যাংক হিসাব খুলতে চেয়ারম্যান ও সচিব যেভাবে ফাইল তৈরী করে দেয়, আমরা সেভাবে হিসাব খুলি। আবার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)’র স্বাক্ষর সহ প্রতিবেদন পাওয়ার পর চেকের টাকা গুলো চেয়ারম্যান বা সচিব নিয়ে যায়।  এটা দীর্ঘ দিনের রীতি।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মো. তারিকুল ইসলামের মুঠোফানে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি প্রশিক্ষনে ঢাকায় আছে জানিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।

দাঁতমারা ইউপি চেয়ারম্যান মো. জানে আলম মুঠোফোনে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমিক তালিকা আমি করিনা। এগুলো করে নারী ও পুরুষ ইউপি সদস্যরা। শ্রমিকরা কাজ করে ব্যাংক থেকে টাকা তোলে। সেখানে আমার কোন হাত নেই।

এ ব্যাপারে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার রায় বলেন, এমন হলে ৪০দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের বিধি ভঙ্গ হবে।  বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখবো। সত্যতা পাওয়া গেলে এই কাজের সাথে যারা জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আইনগ ব্যবস্থা নেবো।