অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

হালিশহরের “সোমা মঞ্জিলে” শোক বাড়াচ্ছে পায়েলের পোশাক ও ছবি

0
.

বাড়ির নাম ‘সোমা মঞ্জিল’। হালিশহর আই ব্লক আবাসিক এলাকার ১৩ নম্বর লেইনের একেবারে শেষের বাড়ি এটি। এ বাড়িরই চতুর্থ তলায় স্বপরিবারে থাকতো সাইদুর রহমান পায়েল। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পঞ্চম সেমিস্টারে পড়তেন তিনি। পড়াশুনার সুবাদে ঢাকা থাকলেও এ বাড়িতেই ঈদ করার কথা ছিল তার। গত মাসে ঢাকা যাওয়ার আগে মা কোহিনূর বেগমকে পায়েল বলেছিলো সে আসলে যাতে কেনা হয় কোরবানীর গরু। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে হানিফ পরিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের নির্মমতায় গত ২২ জুলাই প্রাণ হারান পায়েল।

এ মাসে ঈদও হলো সেই ২২ তারিখে। পুত্রকে হারানোর এক মাস পূর্ণ হওয়ার দিন ঈদ হওয়ায় পায়েলের পরিবারে ঈদ এসেছে শোকের বার্তা নিয়ে। ছেলের শোকে এবার আর গরুই কেনা হয়নি পায়েলদের। ঈদের দিন তাদের ঘরে রান্না হয়নি কোন মাংসও। ঈদের দিন সরেজমিনে পায়েলদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলের ছবি ও পোশাক নিয়ে অঝোরে কাঁদছে পায়েলের স্বজনরা।

.

হালিশহরের বাসায় ছোট্ট একটি কক্ষ আছে পায়েলের। সেই কক্ষে আছে একটি ওয়ারড্রপ। তিন তাকের এ ওয়ারড্রপের প্রতিটিতেই কাপড় রাখতেন তিনি। একেবারে শেষের ড্রয়ারটিতে রাখতেন প্যান্ট ও শার্ট। এক মাস আগে হানিফ পরিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের নির্মমভাবে পায়েলকে খুন করলেও বাসার সেই ওয়ারড্রপে এখনো থরেথরে সাজানো আছে তার জামা কাপড়। তার পড়ার টেবিলে গোছানো আছে বইও। পায়েলের মা কোহিনুর বেগম ও বাবা গোলাম মাওলার শোক বাড়াচ্ছে এসব কাপড় ও বই। মা বাবার সাথে থাকা ছবিও কষ্ট বাড়াচ্ছে তাদের। স্বজনরা এগুলোর মাঝে খুঁজছেন পায়েলকে। আর কাঁদছেন অঝোরে।

ঈদের দিন পায়েলের মা কোহিনুর বেগম বলেন, ‘চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা যাওয়ার আগের দিন আমাকে কোরবানীর গরুর জন্য বাজেট কত জিজ্ঞেস করেছিলো পায়েল। বলেছিলো সে আসলে যাতে কেনা হয় গরু। ঈদের তিন দিন আগে চলে আসবে বলেছিলো পায়েল। কিন্তু আমার ছেলেতো আর এলোনা। আমি এখন কারে নিয়ে ঈদ করবো। কার জন্য গরু কিনবো।’ এসব বলে কোহিনূর বেগম যখন বিলাপ করছিলেন তখন পাশে ছিলেন পায়েলের বাবা হোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘পায়েল না থাকায় আমাদের কারোই এবার ঈদ নেই। আমরা কোন গরু কিনিনি। বাসায় রান্নাও করা হয়নি কোন মাংস।’

.

২১ জুলাই হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিল পায়েল। ২২ জুলাই ভোররাতে প্রশ্রাব করার কথা বলে গাড়ি থেকে নামেন তিনি। এরপর আবার গাড়িতে উঠতে গেলে দরজার সাথে ধাক্কা লেগে আহত হন তিনি। এরপর ‘দায় এড়াতে’ আহত পায়েলের মুখ থেতলে দেয় হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার জনি, চালক জামাল হোসেন ও তার সহকারী ফয়সাল হোসেন। পায়েলকে আহত করে লাশ ফেলে দেয় তারা নদীতে। যে গাড়িতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিল পায়েল সেই গাড়িরই স্টাফরা কোন কারণ ছাড়াই এমন নির্মমভাবে খুন করে তাকে।

পায়েলের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, কালো রঙের তিন তাকের একটি ওয়ারড্রপের পাশে রয়েছে একটি পড়ার টেবিল। আরেক পাশে রয়েছে খাট ও আলমিরা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এলেই এ খাটে ঘুমাতেন পায়েল। এ রুমের প্রতিটি জিনিসে রয়েছে তার হাতের ছাপ। তাই এসব জিনিস ছুয়ে ছেলের স্পর্শ পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন কোহিনুর বেগম। পায়েলের বড় ভাই গোলাম মোস্তফা পলাশ বলেন, ‘পায়েলের ইচ্ছা ছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিবে সে। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না।’ পায়েলের বড় মামা গোলাম সোহরাওয়ার্দী বিপ্লব বলেন, ‘তিন আসামীর দুই জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও হত্যার এক মাস পরেও কেন চার্জশীট হয়নি চাঞ্চল্যকর এ মামলার?’ পায়েলের মেজ মামা কামরুজ্জামান চৌধুরী টিটু জানান, পায়েলের বাবা গোলাম মাওলা ২৬ বছর ধরে কাতারের দোহায় চাকরি করেন। বড় ছেলে গোলাম মোস্তফাও সেখানে থাকেন।

.

পায়েলের মৃত্যু খবর পেয়ে দেশে ফিরেছেন তারা দুজন। পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটি এভাবে অকালে চলে যাওয়ায় শোকে কাঁদছে সবাই। পায়েলের সেজ মামা গোলাম রাসেল চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যেক ঈদে চট্টগ্রামে আসলে আত্বীয় স্বজন সবার সাথে দেখা করতো পায়েল। এবার সে না থাকায় আমাদের মনে কোন ঈদ ছিল না।’

পায়েলের ছোট মামা ফাহাদ চৌধুরী দিপু বলেন, ‘পায়েলের খুনীদের দ্রুতবিচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমরা। শিগগির এ মামলার চার্জশীট না হলে ফের আন্দোলনে যাবো আমরা। কষ্ট ভুলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও সাক্ষাত চাই আমরা।’ প্রসঙ্গত, পায়েল হত্যার দ্রুত বিচারের দাবিতে গত এক মাস ধরে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, ঘেরাও সহ বিভিন্ন অন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে।