অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

পাহাড়ে ২ মাসে ৮ খুন, ১৫ অপহরণসহ ১০ বন্দুকযুদ্ধ

0
.

আলমগীর মানিক,রাঙামাটি
পার্বত্য চট্টগ্রামে হঠাৎ করেই সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে পাহাড়ের মানুষ। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার ঠিক পূর্বক্ষণে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও অস্ত্রবাজির তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এটা কিসের ইঙ্গিত বহন করছে সে চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মানুষ। এদিকে চলতি বছরের পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই পর্যটকবাহি গাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলির প্রেক্ষাপটে মাথায় হাত পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িদের। কপালে চিন্তার রেখা প্রশাসনেরও।

সাধারণত পাহাড়ে অক্টোবর থেকে মার্চ সময়কালকে পর্যটন মৌসুম ধরা হয়। এই সময়কে টার্গেট করেই প্রস্তুতি নেয় পর্যটন ব্যবসায়িরা। অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে রাঙামাটিসহ পাহাড়ি জেলাগুলোতে পর্যটক আগমনের ডেউ দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলো এখানকার ব্যবসায়িরা। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালির মতোই শুক্রবার রাঙামাটি খাগড়াছড়ি সড়কে পর্যটকবাহি গাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলি ব্যবসায়িদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। একদিকে আসন্ন নির্বাচন ও পর্যটন মৌসুম এবং অন্যদিকে যৌথ বাহিনীর চলমান সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের পেক্ষাপটে এ ধরণের সন্ত্রাসী তৎপরতা দুঃশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন, ব্যবসায়ি ও সাধারন মানুষের জন্যে। বলাবাহুল্য যে, গত দুই মাসে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় পরপর অন্ততৎ ৮টি খুন, ১৫টি

অপহরণ, তিনটি হত্যা চেষ্টা ও বাঘাইছড়ি সীমান্তে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালানী চেষ্টাসহ অন্তত দশটি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।

উক্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: গত ১৭ অক্টোবর নানিয়ারচর উপজেলা সদরেই প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের সক্রিয় কর্মী শান্তি চাকমা শান্তকে। এর আগে, অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে নিজের বউ মেরে শাশুরীকে শিক্ষা দেওয়ার মতোই বাঘাইছড়িতে এক গ্রাম প্রধানের মা ও খালাকে নির্মমভাবে কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ৬ই অক্টোবর বান্দরবানের আলিকদমে হত্যার শিকার হয় হেলাল নামে এক ব্যবসায়ি। অক্টোবরের ৭ তারিখে দীঘিনালার মেরুংয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় মঞ্জু চাকমা নামে সংস্কারপন্থী জেএসএস’র এক কর্মীকে। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরের রামসুপারি পাড়ায় রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে হত্যা করা দু’জনকে। ২২ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির রামগড়ে একজনকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা।

.

এদিকে, ৯ অক্টোবর তারিখে রাঙামাটির কাউখালীতে উপজাতীয় দুই ভাইকে অপহরণ করে স্বজাতীয় সন্ত্রাসীরা। এরআগে অক্টোবরের ৩ তারিখে নানিয়ারচর থেকে অপহরণ করা হয় সংস্কারপন্থী জেএসএস এর দুই কর্মীকে, ৪ তারিখে কাপ্তাইয়ের রাইখালীতে যুবকে গুলিবিদ্ধ করা হয়, পানছড়িতে সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে জিম্মি করা হয় ৬ গ্রামবাসীকে, এদিকে ২৭ সেপ্টেম্বর সংবাদ মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, এক সপ্তাহে সংস্কারপন্থীদের হাতে ৭জন গ্রামবাসীকে অপহরণ করা হয়েছে। এরআগে ১৭ই সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় সুমন ত্রিপুরা কর্তৃক ধর্ষন করা হয় এক বাঙ্গালী গৃহবধুকে। এর আগে ১৩ই সেপ্টেম্বর জেলার দাতকুপিয়া এলাকায় সুধাংকর চাকমা কর্তৃক প্রতিবন্ধী নারী লালবানুকে যৌন নির্যাতন করে হত্যার চেষ্ঠা চালানো হয়।

এছাড়াও নিয়ন্ত্রণহীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে এখানকার আঞ্চলিকদলীয়রা। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, রাঙামাটি শহরেই। রাঙ্গাপানিস্থ সুখী নীলগঞ্জে বিকাশে চাঁদাগ্রহণকালে হাতে দুই সন্ত্রাসীকে আটকের পর সদলবলে হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় দুই চাঁদাবাজকে। দিনে-দুপুরে প্রশাসনের হাত থেকে এই ধরনের হামলা চালিয়ে আসামী ছিনিয়ে নেওয়ার দুঃসাহসকে ভাবিয়ে তুলেছে পাহাড়বাসীকে।

এদিকে, আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো অস্ত্র সংগ্রহের অভিযানে নেমেছে এমন তথ্য বেশ জোরালো এসেছে বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা সূত্রে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ত্রের চালান এলে পার্বত্যাঞ্চলে চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া অস্ত্রের চালান জেএসএসের আড়ালে অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী বা সংগঠন ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরাও আমদানি করে থাকতে পারে। এসব অস্ত্র পার্বত্যাঞ্চলের গন্ডি পেরিয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও নাশকতার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের অস্ত্রের চালান যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সব গোয়েন্দা সংস্থাসহ সেনাবাহিনী, বিজিবি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিবিড় এবং নিরবচ্ছিন্ন নজরদারিসহ সতর্কাবস্থায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি এলাকায় অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চক্র। তারা সীমান্তের অপারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো পার্বত্যাঞ্চলের সন্ত্রাসীগ্রুপগুলোকে নানাভাবে সংগঠিত হতে সামরিক সহায়তা করছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী/সন্ত্রাসী সংগঠনের সহায়তায় বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাচার করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। পার্বত্যাঞ্চলে তৎপর বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব অস্ত্র ভারত ও মায়ানমার থেকে আমদানি করে থাকে। সম্প্রতি ভারতের নাগা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ৯২ লাখ টাকায় ২০টি ভারী রাইফেল ও ১০টি রিভলবার সংগ্রহ করেছে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী একটি সংগঠন। খাগড়াছড়ি নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে এমন খবর পেয়ে উক্ত এলাকায় অভিযানও চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন উদ্বর্তন কর্মকর্তা। বাঘাইছড়ির চারজন ব্যবসায়ির মাধ্যমে এই টাকা সংগ্রহ করে অস্ত্রগুলো কিনেছে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী একটি আঞ্চলিক সংগঠন।

নিরাপত্তা বাহিনী ও সীমান্ত সূত্র জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহের গত মঙ্গলবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নাগা সন্ত্রাসীদের ২৪ জনের একটি দল সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করে। শীর্ষ সন্ত্রাসী পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির দোসর এলাকায় আসে দলটি। সেখান থেকে পরবর্তীতে মাচলং এর গভীর অরন্যে ইউপিডিএফর এর সাথে এই অস্ত্রের লেনদেন করে নাগা সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাটি সম্পর্কে বেশ তৎপর হলেও অতি দূর্গমতার কারনে ঘটনাস্থলে পৌছুতে পারেনি। এই ধরনের সশস্ত্র কর্মকান্ড পার্বত্যাঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য খুবই উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্বর্তন সেই কর্মকর্তা।

এদিকে ইউপিডিএফর পক্ষ থেকে এই ধরনের ঘটনাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারনা বলে দাবি করা হয়েছে। পাহাড়ের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মোঃ আলমগীর কবিরের দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি জানান, আমরা বেশ সতর্কভাবেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশের ডিএসবি, এসবিসহ গোয়েন্দাদের সতর্কভাবে মাঠে রাখা হয়েছে। আমরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।, কোনো স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কোনো ঘটনার সাথে সাথেই আমরা সমন্বিতভাবে সেটি মোকাবেলায় প্রশাসন কাজ করছে। পাহাড়ে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি অপহরণ, গুম, খুনসহ সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জবাবে পুলিশ সুপার জনাব আলমগীর কবির বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান আরো জোরদার করাসহ বিভিন্ন ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামীদেরকে আইনের আওতায় আনতে পারলে চলমান পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি ঘটবে এবং আমরা সেলক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।