অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেশবাসীর প্রতি খালেদার আহবান

2

khaled_125313সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার হঠকারী, অযৌক্তিক ও অলাভজনক রামপালের সকল কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আমি এই দাবির পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।

বেগম খালেদা জিয়া বলেন, দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনের স্বাচ্ছন্দের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি দেশ এবং দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, জনজীবন বিপর্যস্থ হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ধ্বংস হয় – তাহলে সেই সিদ্ধান্ত হয় দেশ বিরোধী-গণবিরোধী। বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ঠিক তেমনি একটি দেশ বিরোধী-গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।

বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের অস্তিত্বের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করে বেগম জিয়া তার দাবি করে বলেন, কেবল পরিবেশগত ঝুঁকি নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই কেন্দ্রটি লাভজনক হতে পারে না। এজন্য এই কেন্দ্র বাতিল করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প সন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

লিখিত বক্তব্যে রামপাল প্রকল্প নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন তিনি। তবে লিখিত বক্তব্যের পর তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। খালেদা জিয়া বলেন, ‘আজ আমি যে বক্তব্য তুলে ধরেছি, সেটাই আপনারা প্রচার করুন। এই বক্তব্য কেবল আমার একার স্বার্থ নয়, দেশ ও জনগণের সবার স্বার্থ জড়িত। এটা বুঝে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিন।’

বাগেরহাটের রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসির সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। দেশের বিদ্যুৎঘাটতি মোকাবেলায় এই প্রকল্প নেয়া হলেও পরিবেশবাদী এবং বামপন্থি বিভিন্ন সংগঠন এর বিরোধিতা করে আসছে। এই বিদ্যুৎকেন্ত্র চালু সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছে তারা। বিএনপি নেতারাও নানা সময় এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও খালেদা জিয়া সরাসরি এ নিয়ে কথা বলেননি এতদিন।

সরকার বলছে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে পৃথিবীর অনন্য একটি স্থাপনা। এ থেকে দূষণের কোনো আশঙ্কা নেই।

তবে খালেদা জিয়া সরকারের এই যুক্তিকে জেদাজেদি বলছেন। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ২০ দলীয় জোট ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি নেত্রী।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনের স্বাচ্ছন্দের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি দেশ এবং দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনজীবন বিপর্যস্থ হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয় – তাহলে সেই সিদ্ধান্ত হয় দেশ বিরোধী-গণবিরোধী। বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ঠিক তেমনি একটি দেশ বিরোধী-গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।’

খালেদা জিয়ার দাবি, ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুরে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব যে কারণে বাতিল হয়েছে রামপালেও একই কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায় না। তিনি বলেন, ‘ভারতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আইনি বাধা আছে। অথচ সে দেশেরই একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের নিজের দেশে যা করতে পারে না শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে তা বাংলাদেশে করছে। আর জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন এবং দেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন বাংলাদেশ সরকার তার অনুমতি দিয়েছে।’

খালেদা জিয়া বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে এবং তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে সুদূর প্রসারী। তিনি বলেন, আমেরিকার টেক্সাসে ফায়েত্তি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফারডাই অক্সাইড নির্গত হতো। এর ফলে ৪৮ কিলোমিটার জুড়ে গাছপালা ধ্বংস হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বিএনপি নেত্রী বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রার দূষণকারী উপাদান থাকে। সে কারণে পৃথিবীর সব দেশে এই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অবলম্বন করা হয়। কিন্তুরামপালে এই নীতি অনুসরণ না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ফলে রামপাল থেকে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার ১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদীতে পড়বে, যা পুরো সুন্দরবন এলাকার পরিবেশের উপর ধ্বংসকারী প্রভাব সৃষ্টি করবে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এই প্রকল্পে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করলেও ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড এবং ৮৫ টান নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড সুন্দরবন ও তার আশপাশের অঞ্চলকে ধ্বংস করবে।

সকার সুন্দরবনকে আবাসিক ও গ্রাম এলাকা দেখিয়ে জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে বলেও অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। বলেন, ‘একই ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি দিয়ে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা স্থানীয় এলাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে না বলে।’ এই কেন্দ্র থেকে সাত লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাইঅ্যাস ও দুই লাখ টন বটম অ্যাস বর্জ্য তৈরি হবে। এতে পারদ, সীসা, নিকেল, আর্সেনিক, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদির মত বিভিন্ন ক্ষতিকর ও তেজ:স্ক্রিয় ভারী ধাতু মিশে থাকে। এগুলো সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ে তেজ:স্ক্রিয় দূষণ ঘটাবে এবং নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করবে।

খালেদা জিয়া  বলেন, ‘এই প্রকল্পের কঠিন বর্জ্যরে একটি অংশ দিয়ে এক হাজার ৪১৪ একর নীচু জমি ভরাট করার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা পরিবেশের জন্য আরও মারাত্মক হবে। এসব বর্জ্য বাতাসে উড়ে আশ-পাশের এলাকা এবং পানিতে ভিজে ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে নদীর পানি বিষাক্ত করবে।

কয়লা পরিবহন করার সময় জাহাজ থেকে কয়লার গুড়া নদী, খাল, দূষণ করবে বলেও আশঙ্কা করছেন খালেদা জিয়া। বলেন, কয়লা পরিবহনকারী জাহাজের ঢেউ পশুর নদীর দুই তীরের ভূমি ক্ষয় করবে, যন্ত্রপাতি শব্দদূষণ ঘটাবে এবং রাতের বেলায় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো সংরক্ষিত বনে পশুপাখির জীবনচক্রে মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আর্থিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য লোকসানের হবে বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া। বলেন এই প্রকল্পে বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতীয় কোম্পানি ১৫ শতাংশ করে বিনিয়োগ করবে। বাকি টাকা ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। কোম্পানি বন্ধ হলে বা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ফলে ভারতীয় কোম্পানি ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ৫০ শতাংশ মুনাফা নেবে বলে অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া।

আমদানি করা কয়লার দাম টনপ্রতি ১৪৫ ডলার নির্ধারণ হয়েছে দাবি করে বিএনপি নেত্রী বলেন, এখান থেকে পিডিবিকে ইউনিটপ্রতি আট দশমিক ৮৫ টাকা দরে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। অথচ পিডিবি মাওয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান অরিয়ন গ্রুপের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি চার টাকা এবং খুলনার লবনচরা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারা কেন্দ্র থেকে তিন টাকা ৮০ পয়সা মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘পরিবেশ বিবেচনায় না নিলেও জেনে শুনে এমন একটি লোকসানি প্রকল্পে সরকার কি উদ্দ্যেশে এবং কার স্বার্থে জড়ালো Ñ এটাই জনগণের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক জবাব নেই বলেই সরকার এই প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করছে।’

বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে নানা পরামর্শও দেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘বিকল্প বিদ্যুৎ ও বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করা উচিত। ছোট গ্যাস জেনারেটর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানি বিদ্যুৎ, টাইডাল বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস প্রকল্প, সৌর বিদ্যুতের দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া দরকার।

বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্থানেরও অনেক বিকল্প আছে। কিন্তু সুন্দরবনের কোন বিকল্প নেই।’

২ মন্তব্য
  1. Noushin Chowdhury বলেছেন

    এখন সময় এসেছে তাই সবাই মিলে এক হয়ে ধ্বংশ্বাত্বক চুক্তি বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।