অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

ইসলামের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ পালন

0
.

বক্তব্যের শুরুতেই এ কথা বলে রাখা ভাল যে, এ ব্যাপারে কয়েক ধরনের কথা চালাচালি হয়। একদল বলে পহেলা বৈশাখ পালন বৈধ। অন্য দল বলে এটা সম্পূর্ণ অমুসলিমদের অনুষ্ঠান হওয়ায় তা হারাম। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে এটা কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা রাখে তা পর্যালোচনা করার প্রয়াস পাব।

বছর শেষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বাঙ্গালি সংস্কৃতির আদলে চলছে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসব ”পহেলা বৈশাখ”। বাঙ্গালি সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা অত্যন্ত জমজমাটপূর্ণভাবে হৈ চৈ করে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়। আর এ উৎসবকে ঘিরে আমরা মুসলমান দাবিদার ভুলে যাই ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার কথা। বাংলা নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে বাঁধভাঙ্গা উৎসবে মেতে ওঠেন বাঙ্গালি সংস্কৃতির ধারকরা। সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে উৎসব আমেজ, নতুন বার্তা নিয়ে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষের সূর্য উঁকি দেয় বাংলার আকাশে।
(ক). ইতিহাস যা বলে : বাংলা সনের প্রথম প্রবর্তক কে? এই নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশের মতে, সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সনের উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন, স্বাধীন বাংলার সুলতানেরা এ সনের সূচনা করেন। আবার কারো মতে, রাজা শশাঙ্ক বা আরো পুরানো কোন নৃপতি এ কাজ করেন। তবে দুটি মত বেশি পাওয়া যায়।
১.প্রথম মত অনুযায়ী : প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। আসলে এ মতের কোন শক্তিশালী ভিত্তি নেই । বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের মতে, সন আরবী শব্দ। আর তখন আরবী প্রচলন ছিল না এবং বঙ্গ নামে তখন কোন প্রদেশ পরিচিত ছিল না। তাই বাংলা সনের প্রবর্তক রাজা শশাঙ্ক অকল্পনীয়।
২.দ্বিতীয় মত অনুসারে : উপমহাদেশে ইসলামী শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। আর হিজরি সন চন্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় তা সৌর বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হত। কারণ, সৌর বছর ৩৬৫ দিনে আর চন্দ্র বছর ৩৫৪ দিনে হয়। এ কারণে চন্দ্র বছরের ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। আর বাংলার চাষাবাদ এই ঋতু নির্ভরশীল । এ জন্য সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ,জ্যোর্তিবিদ ‘আমীর ফতেহ উল্লাহ্ সিরাজী’কে হিজরি বর্ষ পঞ্জিকাকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রুপান্তর করতে নির্দেশ দেন। তিনি সৌর বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রণয়ন করেন। তবে স¤্রাটের আদেশে ২৯ বছর পূর্বে ১৫৫৬ সালে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকার প্রচলনের নির্দেশ দেন। আর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বা ৯৬৩ হিজরি সনের মুহাররাম মাস ছিল “বাংলা বৈশাখ” মাস। এ জন্য ‘বৈশাখ’ মাসকে বাংলা নববর্ষের মাস ধরা হয় এবং একে ‘ফসলি’ মাসও বলা হত। কারণ, ১লা বৈশাখ এলে হালখাতা, খাজনা প্রদান ও ফসল তোলার বা বপনের মওসুম শুরু হয়। ১(ড.খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর,খুতবাতুল ইসলাম, পৃ: ৪৪৪ )

বাংলা ক্যালেন্ডারের বৃত্তান্ত : সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ “তারিখ-ই-এলাহি” নামে শুরু হয়। তবে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ শেষে আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছর ১৫৫৬ থেকে এ হিসেব শুরু হয়। সেই সময় “লক্ষ্ণণাব্দ, বিক্রমাব্দ, জালালি সন, সিকন্দর সন, সপ্তাব্দ, শকাব্দ” ইত্যাদি নামে ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। আর পহেলা বৈশাখ নববর্ষ হিসেবে পালন হয় তার আমলেই। সে সময় বিভিন্ন পালা-পার্বনের সংখ্যা ছিল চৌদ্দটি। তার মধ্যে একটি অন্যতম উৎসব হলো ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ পালন উৎসব। যা ১লা বৈশাখের দিনটিই সেই দিন। এই ‘নওরোজ’ উৎসবের সময়েই যুবরাজ সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) মেহেরুন্নিসার (নুরজাহান) প্রেমে পড়েন। এ ভাবে বাবার নওরোজ উৎসবেই যুবরাজ খুররম (শাহ জাহান) প্রথম চোখের দেখায় হৃদয় দিয়ে ফেলেন কিশোরী মমতাজকে। এ কারণেই ইতিহাসে ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ উৎসব অমর হয়ে থাকে। ২ (ড.খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর,খুতবাতুল ইসলাম, পৃ: ৪৪৫)
বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি আরবী ক্যালেন্ডার ‘হিজরি’ থেকে। ৬২২ খিস্টাব্দে বিশ্বনবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ক্যালেন্ডারের উদ্ভব হয়। এতে মুহাররম মাসের প্রথম দিন ছিল বছরের পহেলা দিন। আর এ হিসেবে প্রথম বাংলা ক্যালেন্ডার শুরু হয় ৯৬৩ হিজরি থেকে, সেই বছরের প্রথম দিন মুহাররম মাসের প্রথম দিন। তখন বাংলায় ভূমি-রাজস্ব আদায়ের জন্য এই ক্যালে-ারকে ‘ফসলি সন’ বলা হত। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাসের ও দিনের হিসাব তৈরি করে। সেই হিসেব অনুযায়ী, বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত ৩১ দিনের মাস। আশ্বিন থেকে চৈত্র ৩০ দিনের মাস। আর ‘লিপ-ইয়ারের’ ৩৬৬তম দিনটি যুক্ত হবে ফাল্গুন মাসের সঙ্গে। একে বলা হয় ‘তিথি’। তিথি হল চন্দ্রের পৃথিবী পরিক্রমার দিনের হিসেব। আর ৩০ তিথির অর্ধেক ১৫ হল ‘শুক্লা’। বাকি ১৫ দিন ‘কৃঞ্চা’। ৩ (www.currentissuebd.com, page: 24-25)

পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বরের এক সভায় ১৯৯৫ সাল থেকে ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা অধ্যাবধি চলে আসছে।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ ‘আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী’ এবং ‘আকবর নামা’র রচয়িতা আবুল ফজল যে ক্যালেন্ডার তৈরি করেন তাতে মাসের নামগুলো ছিল এ রকম- ১.কারওয়াদিন ২.আর্দি ৩. বোহসু ৪. খোরদাদ ৫. টীর ৬. অমরদাদ ৭.শাহরিয়ার ৮. আবান ৯. আজুর ১০. ডই ১১. আহাম ১২. ইস্ফান্দ।
পরবর্তীকালে বাংলা মাসের নাম কিভাবে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ হয় তা জানা যায় নি। তবে ধারণা করা হয় ‘শক রাজ বংশের’ স্মরণার্থে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত ‘শকাব্দ’ থেকে তারকা ভিত্তিক এ নামগুলো এসেছে। যেমন- ১.বিশাখা থেকে বৈশাখ ২.জ্যোষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ ৩. কর নক্ষত্র থেকে আষাঢ় ৪. শ্রাবণী নক্ষত্র থেকে শ্রাবণ ৫.ভদ্রপদ নক্ষত্র থেকে ভাদ্র ৬. আশ্বনী নক্ষত্র থেকে আশ্বিন ৭.কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে কার্তিক ৮. অগ্রহায়ণী থেকে অগ্রহায়ণ ৯.পুষ্য নক্ষত্র থেকে পৌষ ১০. মঘা নক্ষত্র থেকে মাঘ ১১.ফাল্গুনি থেকে ফাল্গুন ১২.চিত্রা থেকে চৈত্র।

অনুরূপভাবে বাংলা বারের নামগুলো সম্রাট শাহ জাহান পর্তুগীজ পণ্ডিতের সহায়তায় ইউরোপীয়দের ব্যবহৃত রোমান নামকরণ পদ্ধতির সঙ্গে অনেকটাই মিল রেখে তৈরি করেন।
(খ). ইসলামের আকিদাহগত দৃষ্টিকোণ থেকে : ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যা সমগ্র মানব জাতির উপযোগী করে আল্লাহ তা‘য়ালা প্রবর্তন করেছেন। তাই এর বিধানগুলো কোনটাই কোনো ভৌগোলিক সীমার দ্বারা আবদ্ধ নয়। প্রতিটি জনপদের মানুষের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে । যা তাদের ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যা হাজার বছরের ক্রমবিবর্তনে গড়ে উঠেছে। আর ইসলাম কোন বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতি অন্য অঞ্চলের ওপর চাপিয়ে দেয় নি। তেমনি কোন আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করে নি। বরং ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে কেবল অশ্লীলতা, অন্যায়, অপচয় ও আল্লাহর নাফারমানিকে। আল্লাহ বলেন- “আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’৪(সূরা বনী-ইস্রাইল, আয়াত নং: ২৬-২৭) সে দৃষ্টিকোণ থেকে আবহমান কাল থেকে চলে আসা ‘নবান্ন উৎসব বা ১লা বৈশাখ’ এর উৎসব শরিয়ত পরিপন্থি হবার কথা নয়। কারণ, পূর্বেই আমরা জেনেছি এটা কোন ধর্মীয় বা হিন্দু প্রথার কারণে উৎপত্তি হয় নি। এটাকে সরাসরি হারাম ঘোষণা করা যেত যদি কোন অমুসলিম বা কাফেরদের ধর্মের উৎসব হত। কারণ, রাসূল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি অন্য ধর্মের সাথে সাদৃশ্য রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।” ৫(আবু দাউদ, খণ্ড-৪, পৃ: ৪৪, হা: ৪০৩১; মুসনাদে আহমদ, খণ্ড-৯, পৃ: ১২৬) এটাকে নিছক জাতিগত প্রথা বলা চলে। তবে উৎসবের নামে যদি অশ্লীলতা, অন্যায়, অপচয় ও আল্লাহর নাফারমানি হয় সেটা অবশ্যই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং হারাম হিসেবে পরিগণিত হবে। কেননা যা দ্বারা মানব সমাজে অশান্তি ডেকে আনবে, তা ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কখনোই কাম্য নয়। একজন বাংলাদেশী মানুষ বাংলায় কথা বলবে, বাঙ্গালি খাবার খাবে এবং দেশীয় বাঙ্গালি পোশাক পরিধান করবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। তেমনি আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তার সাহাবীগণ আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তারা ‘আরবী ভাষায় কথা বলা, আচার-আচরণ, রুচি-অভিরুচি, খদ্যাভ্যাস এবং আরবীয় লম্বা (জুব্বা) পোশাক’ পরিধান করতেন। কিন্তু এর সঙ্গে ইমলামের আকিদাহগত কোন সম্পর্ক নেই। কারণ আল্লাহ্ তা‘য়ালা প্রত্যেক জাতি ও অঞ্চলে তার দূত বা রাসূল পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন-“আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই পথপ্রদর্শক রয়েছে। ৬(সূরা রা‘দ, আয়াত- ৭)
(গ). শরিয়তের মানদণ্ডে পহেলা বৈশাখ : বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে “কৃষি সংস্কৃতি”কে বোঝায়। কারণ আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ। বাংলার ৮০% মানুষ কৃষির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। আর বাংলার কৃষক ধর্মে কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু, কেউ উপজাতি বা অন্য ধর্মের অনুসারী যেটাই হোক না কেন, তার জীবনের আনন্দ, বেদনা, উৎসব, আশা-নিরাশার সঙ্গে “ফসল ও ফসলী ” বছরের নিবিড় বন্ধন থাকবে এটা স্বাভাবিক জ্ঞানেই বোঝা যায়। তাই চৈত্রসংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি কৃষি নির্ভর বাঙালির জীবনযাত্রার মানদণ্ড। যা হোক, এই উৎসবগুলো কি ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ না অবৈধ ? তা পর্যালোচনা করি।

লেখক : এইচ.এম. রেজওয়ান শিকদার,শিক্ষক, ধামরাই হার্ডিঞ্জ উচ্চ- বিদ্যালয় ও কলেজ।