অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

‘মাদ্রসার হুজুরেরা আমার মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে’

0
.

সীমা বেগম। বয়স ৩২। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে ঢাকার আদালত পাড়ায় ঘোরাঘুরি করছেন। প্রায় সময় তার চোখে জল দেখা যেত। তাকে আদালতে দেখে কথা বলার কৌতূহল জাগে। আদালতে কেন ঘোরাঘুরি করছেন জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে মুবারর মুনতাহা ওরফে সানজিদা রশিদ মীম (১৪) রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসায় নাজরানা শ্রেণিতে পড়তো। দেখতে খুব সুন্দর ছিল। মাদরাসার আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় সেখানে থাকতো। সে দেখতে সুন্দর হওয়ায় মাদরাসার হুজুরেরা তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গত বছরের অক্টোবর মাসে হুজুরেরা তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিচার পাওয়ার আশায় আদালত পাড়ায় ঘোরাঘুরা করছি। আসামিরা খুব প্রভাবশালী। তাদের প্রচুর টাকা রয়েছে। তারা টাকা দিয়ে সবকিছু নিজের মতো করে নিচ্ছে। জানি না মেয়ে হত্যার বিচার পাবো কিনা! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকূল আবেদন আমার মেয়ের হত্যাকারীদের যেন বিচার হয়।’

তিনি বলেন, গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর মাদরাসার আবাসিক হলে আমার মেয়েকে হুজুরেরা ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর তা আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার জন্য গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। তার পায়ের নিচে কাটা দাগ ছিল। কোমরের নিচে ছিল আঘাতের চিহ্ন। মাথা ছিল স্বাভাবিক। যদি সে ফাঁস দিয়ে মারা যেতে তাহলে কেন তার পায়ের নিচে কাটা দাগ থাকবে। কোমরের নিচে কেন আঘাতের চিহ্ন থাকবে। আর মাথাইবা কেন স্বাভাবিক থাকবে? প্রশ্ন সীমা বেগমের।

হুজুরেরা নিজেরা বাঁচার জন্য আমার মেয়ের পায়ের নিচে অন্যের হাতের লেখা একটি চিরকুট ফেলে রাখে। চিরকুটে আবাসিক শিক্ষিকা তাসলিমার নাম লেখা হয়।

ঘটনা ধামাচাপা দিতে টাকার লেনদেন

সীমা বেগম বলেন, আমার মেয়ের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তাদের পক্ষে করার জন্য ডাক্তারকে আমার সামনে দুই লাখ টাকা দিয়েছে। আমি তার বাস্তব স্বাক্ষী। এছাড়া পুলিশকেও তারা অনেক টাকা দিয়েছে। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় অনেক টাকা খরচ করেছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা যেন এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি সে জন্য অন্যের মাধ্যমে আমাদের ৫০ লাখ টাকা দিতে প্রস্তাব দিয়েছে। আমি বলেছি আমার টাকার প্রয়োজন নেই, মেয়ের হত্যার বিচার চাই।

মাদরাসার পরিচালকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সানজিদা রশিদ মীমকে ধর্ষণ করে হত্যা করার অভিযোগে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসার পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ মুমতাজুল করিম ওরফে মোস্তাক আহম্মেদসহ (৫৫) আট জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার মা সীমা বেগম।

ঢাকার ৭ নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গত ৭ নভেম্বর এই মামলাটি করা হয়। মামলায় ধারা দেওয়া হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ৯ (৩)/৩০। আদালত পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।

মামলার অপর আসামিরা হলেন-মাদরাসার পরিচালকের ছেলে হামীম মিয়া (৩১), মাদরাসার শিক্ষা সচিব হোসাইন আহম্মেদ (৩২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ (৩২), মাদরাসার দারোয়ান আবুল (৪৫) কালাম, মহিলা শিক্ষিকা তাসলিমা আক্তর নিপা (২৬), বুয়া রওশন আরা (৪০) ও রামপুরা আবু সাঈদ রেস্তোরাঁর মালিক আব্দুল আজিজ আকন্দ (৫৯)।

মামলার অভিযোগে সীমা বলেন, আমার মেয়ে সানজিদা রশিদ মীমকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসায় ভর্তি করাই। মাদরাসায় আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় মীম সেখানে থেকে পড়ালেখা করতো। ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে আমার মেয়েকে প্রতিদিনের মত খাবার দিতে গেলে ৬ জন শিক্ষক আমাকে আমার মেয়ের সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলে। মেয়ে কোথায় জানতে চাইলে তারা বলে সে পড়ালেখা করছে। তাদের কথায় সন্দেহ হলে আমার স্বামীকে খবর দেই। সকাল ১১ টার দিকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ আসে। পুলিশের সঙ্গে মামলার সাক্ষীরা ছাদে গেলে দেখতে পায় আমার মেয়ের মরদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় এবং পা ছাদের ফ্লোরের সাথে লাগানো। সাক্ষীরা পুলিশের নির্দেশে আমার মেয়েকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ছাদের ফ্লোরে নামান। সাক্ষীরা ঝুলানো অবস্থা থেকে মৃত কন্যাকে নামানোর পর তাহার দুই হাতে কজ্বিতে কালো দাগ, পায়ের নিচে কাটা রক্তাক্ত ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধস্তাধস্তির কারণে জখমের চিহ্ন দেখেতে পায়।

আমার স্বামী তার কন্যার লাশ আনতে হাতিরঝিল থানায় গেলে পুলিশ সারাদিন তাকে থানায় আটকে রাখে। কন্যার লাশ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে একটি কাগজে জোর করে স্বাক্ষর নেয়। এই বিষয় কোনো বাড়াবাড়ি না করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপস করার জন্য হুমকি দেয় পুলিশ। হত্যার বিষয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ বলে আমার স্বামী ইতোপূর্বে মামলা করেছেন। কোর্টে গিয়ে তার খবর নিতে বলে। কোর্টে গিয়ে দেখেন কন্যার মৃত্যুর বিষয় শুধুমাত্র তাছলিমা বেগমের নামে মামলা হয়েছে।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক খালেদ সাইফুল্লাহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয় তাছলিমা আক্তর নিপার বিরুদ্ধে সানজিদা রশিদ মীমকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেয়ার বিষয় সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় করা একটি মামলা বিচারাধনী। অপর আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আর হামিম মিয়া নামে কোনো ব্যক্তি বাস্তবে পাওয়া যায়নি।

কোমরের পাশে দাগ ছিল, অন্যসব ছিল স্বাভাবিক

মীমের মৃত্যুর পর সুরতহাল করেন হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক শরিফুল ইসলাম। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন, সানজিদা রশিদ মীমের লাশ মাদরাসার পাঁচ তলার টিনশেটের সাথে কমলা রঙয়ের ওড়নার দ্বারা ফাঁস লাগানো অবস্থায় পায়ের পাতা রুমের ফ্লোরে লাগানো অবস্থায় পাই। বুক, পেট ও পীঠ স্বাভাবিক ছিল। কোমড়ের ডান পাশে দাগ পরিলক্ষিত হয়। হাত ও মলদ্বার স্বাভাবিক ছিল।

বাদী পক্ষের আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান বলেন, মীমের লাশটির পা মেঝেতে লাগানো ছিল! ফ্লোরের সঙ্গে পা লাগানো থাকলে ফাঁস কিভাবে লাগাবে? আত্মহত্যাকারীদের মাথা সাধারণত একদিকে বাঁকা হয়ে হয়ে যায়। তার মাথা ছবিতে দেখা যায় স্বাভাবিক মানুষের মতোই ছিল। বাদীর সামনে ঢাকা মেডিকেলে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আসামির পক্ষে করার জন্য টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সময় মতো না পাওয়ায় এবং তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভিকটিম মীমের লাশ পুনরায় ময়নাতদন্ত করা সম্ভব নয়। কারণ এতদিনে মৃতের লাশটি পচে গেছে। তাই পুনরায় ময়নাতদন্ত করে আর কিছু পাওয়া যাবে না। এভাবে হত্যাকাণ্ড আত্মহত্যা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। পিবিআই এর প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আমরা নারাজি দেবো।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, এই বিষয় আমি আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছি। আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। তারা ইচ্ছা করলে প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিতে পারবেন।

মীমের বাবা হারুন মোল্লা বলেন, আমার মেয়েকে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসার হুজুরেরা ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে। তাদের অনেক টাকা। তারা টাকা দিয়ে সব নিজের মতো করে নিয়েছে। আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই।

তিনি বলেন, আমি থানায় কোনো মামলা করিনি। কন্যার লাশ নেওয়ার জন্য পুলিশ জোর করে আমার কাছে থেকে স্বাক্ষর নেয়। এ বিষয় কোনো বাড়াবাড়ি না করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপস করার জন্য পুলিশ হুমকি দেয়।

সীমা বেগম বলেন, মাদরাসার পরিচালকের ছেলে হামীম মিয়া। ধর্ষণের মূল হোতা সে। ঘটনার পর তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসার পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ মুমতাজুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, তারা যে অভিযোগ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। আমরা জড়িত নই বলে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়েছে। আর হামীম মিয়া নামে আমার কোনো ছেলে নেই।

উল্লেখ্য, রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসাটি ১৯৯২ সালে স্থাপিত হয়। এখানে বর্তমানে মাদরাসা সিলেবাসে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এবং অন্যান্য জামাআতে পড়ানো হয়। এতে মক্তব, হিফজ ও কিতাব বিভাগ আছে। মাদরাসায় বর্তমানে ৭৮০ জন আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রী, ৪৫ জন শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী আছে। বর্তমানে মাদরাসাটি পরিচালনা করছেন চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ মুমতাজুল করিম। –সুত্রঃ আমাদের সময়।