অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

মাহে রমজানের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা

0
.

সিয়াম সাধনার মাসসিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজানের পবিত্রতা, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে মুসলমানের অবশ্যই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে সংশোধন করে আত্মসংযম, শালীনতা ও সদাচরণ প্রদর্শনের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। ইসলাম পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার ওপর বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এ জন্য রমজান মাসে মানুষের দেহ-মন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা অতি পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন, তিনি পরিচ্ছন্ন ও পরিচ্ছন্নতাকে ভালোবাসেন।’ (তিরমিজি)

রোজাদার ব্যক্তির শরীর-মন, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিচ্ছন্ন রাখার প্রয়োজন অত্যাবশ্যক। আরবিতে পরিচ্ছন্নতার প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘তাহারাত’, ‘নাজাফাত’ বা ‘জাকাত’-এর অর্থ পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিপাটি ও দুর্গন্ধমুক্ত নির্মল অবস্থা। শরিয়তের পরিভাষায় বিশেষ পদ্ধতিতে অর্জিত দেহ, মন, পোশাক, স্থান বা পরিবেশের পবিত্রতা ও নির্মলতাকে পরিচ্ছন্নতা বলা হয়। হাদিস শরিফে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাকে ইমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ।’

মাহে রমজানে সুস্থ-সবল দেহ-মন নিয়ে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করা ও তা কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে শরীর, মন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন তথা পবিত্র রাখা। সুস্থ দেহ ও উন্নত মন-মানসিকতার জন্য রোজাদারদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল, মার্জিত ও শালীন পোশাক পরিধান করা বাঞ্ছনীয়। পোশাক পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৩১)

পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখা ইবাদতের ক্ষেত্রে ফরজ। দৈহিক রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে হলে শরীরকে সব সময় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, দৈনন্দিন জীবনে রোজাদারদের কাপড়চোপড় ধৌত ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় এবং পরিষ্কার পাত্র থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম সুন্নত হচ্ছে রমজান মাসে সেহির ও ইফতার তথা সব সময় পানাহারের আগে ও পরে হাত ধুয়ে নেওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অমিয় বাণী: ‘তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠে হাত তিনবার না ধুয়ে যেন কোনো পাত্রে হাত না ঢোকায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রমাণ করে। পরিচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায় শারীরিক পবিত্রতা। শরীর অপবিত্র-অপরিচ্ছন্ন নোংরা ও অপরিষ্কার থাকলে নানা ধরনের রোগ হয়। প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ বা মিসওয়াক না করলে দাঁতের মাড়িতে রোগ হয়ে অকালে দাঁত পড়ে যায়। প্রস্রাব-পায়খানা ভালোভাবে না হলে এবং নখ বড় রাখলে রোজাদারদের পেটের অসুখসহ বিভিন্ন রকম পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রমজান মাসসহ সর্বাবস্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে দেহ-মন ভালো থাকে, ধর্মীয় কাজে উদ্দীপনা আসে; আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয়।

ইসলামের সব গুরুত্বপূর্ণ অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা, হজ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি কাজে শরীর, পোশাক ও স্থান তথা পরিবেশ পরিষ্কার ও পূতপবিত্র হওয়া একান্ত অপরিহার্য কর্তব্য। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য প্রতিদিন পাঁচবার অজু করতে ১৫ বার হাত, পা, নাক, মুখ, চোখ ও মাথা ধুতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) শরীর পরিষ্কার রাখতে ধর্মভীরুদের জোরালো তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টদায়ক না মনে করতাম, তাহলে প্রত্যেক নামাজের অজুর সঙ্গে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।’ (বুখারি) চুল, নখ ইত্যাদি বড় হলে দৃষ্টিকটু লাগে। তাই দৈহিক সৌন্দর্য রক্ষার জন্য এগুলো থেকে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হয়। একদা এলোমেলো চুলের অধিকারী এক ব্যক্তিকে দেখে নবী করিম (সা.) বললেন, ‘যার মাথার চুল আছে, সে যেন তার পরিচর্যা করে।’ (আবু দাউদ)

শরীরের ন্যায় পোশাক-পরিচ্ছদ অপরিচ্ছন্ন থাকলেও ইবাদত করা যায় না। রোজাদারদের নামাজ কবুল হওয়ার জন্য পোশাক-পরিচ্ছদকে অবশ্যই পবিত্র রাখতে হবে। শরীর পাক, কাপড় পাক, জায়গা পাক—এগুলো হচ্ছে নামাজের পূর্বশর্ত। দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকের সঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেলা ও মেলামেশা করতে হয়। পোশাক-পরিচ্ছদ অপরিষ্কার ও আবর্জনাযুক্ত থাকলে সমাজের কেউ তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে চায় না। তাই সামাজিক জীবনে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হলে রমজান মাসে দেহ-মন, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিচ্ছন্ন রাখা একান্ত জরুরি। যে রোজাদার ব্যক্তি ভেতরে-বাইরে পবিত্রতা অর্জন করেন, তিনি অবশ্যই সাফল্য লাভ করেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে, তাদেরও ভালোবাসেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২২২)

সমাজজীবনে সুস্থ ও শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট প্রভৃতি মানুষের চারপাশে যা কিছু আছে, তা পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ সুন্দর ও সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’ (মুসলিম)

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভের সহায়ক। মাহে রমজানে ধর্মপ্রাণ মানুষের শরীর, মন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি, ইহলৌকিক কল্যাণ তথা সুস্থতা-সৌন্দর্য ও পারলৌকিক মুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রকৃত রোজাদার মুসলমান হিসেবে ইসলামের দিকনির্দেশনার আলোকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সদা সচেতন থাকা আমাদের মানবিক, সামাজিক ও ইমানি দায়িত্ব এবং অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।

ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, ধর্মবিজ্ঞান অনুষদ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com