.

পাওয়ার বা শক্তি সবসময় মানুষকে অনেক বেশি টেনেছে। শক্তি সেটা প্রাকৃতিক হোক কিংবা মানবসৃষ্ট – সভ্যতার উন্নয়নের জন্য সবসময় মানুষ একে ব্যবহার করতে চেয়েছে। মাটি খুঁড়ে, আকাশ ফুঁড়ে শক্তির উৎসে পৌঁছতে চেয়েছে মানুষ। আর সেটা হবেই বা না কেন? দৈনন্দিন জীবনে মানুষের অন্যতম বড় প্রয়োজনটি হলো শক্তি। ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, এমনকি ঘুমানোর সময়ও মানুষ ব্যবহার করে নানারকম শক্তিকে। বিশেষ করে, বর্তমানে নানারকম প্রযুক্তিগত পণ্য যেমন মোবাইল ফোন শক্তির ব্যাপারে মানুষকে আরো বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছে।

একবার ভাবুন তো, আপনার ফোনে চার্জ নেই! সারা পৃথিবী থেকেই যেন বিচ্ছিন্ন মনে হয় নিজেকে, তাই না?

গবেষকেরা এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন যেটি একটি নমনীয় এন্টেনাকে রেডিও তরঙ্গ ধরার ক্ষেত্রে সাহায্য করে ; Image Source: d1w9csuen3k837.cloudfront.net

কিন্তু মোবাইলে চার্জ দেওয়াটাও কি কম ঝামেলার? শক্তির কোনো উৎসের কাছে আপনাকে থাকতেই হবে ফোনে চার্জ দেওয়ার জন্য। লাগবে চার্জার, ডাটা কেবল ইত্যাদি। আর হঠাৎ করে যদি দেখেন ফোনের চার্জ আর নেই, সাথে যদি চার্জ দেওয়ার মতো কিছু না থাকে, সে কথা না হয় বাদই দিলাম। কী করেন আপনি এমন সময়গুলোতে? নিশ্চয়ই মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না আপনার? এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এবার চলে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। কেমন হতো বলুন তো, যদি আপনি কিছু না করেই আপনার ফোনকে চার্জ করতে পারতেন? না, এজন্য আপনার কোনো চার্জার বা কোনো ডাটা কেবলেরও দরকার হবে না। কীভাবে সম্ভব এমনটা? খুব সহজে। ওয়াইফাই এর মাধ্যমে!

এক্ষেত্রে গবেষকেরা এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন যেটি একটি নমনীয় এন্টেনাকে রেডিও তরঙ্গ ধরার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এটি দ্বিমাত্রিক সেমিকন্ডাক্টরের সাথে যুক্ত করে সিগন্যালকে সরাসরি ব্যবহারোপযোগী ভোল্টেজ বা ডিসিতে পরিণত করে। এই পর্যায়ে এই ভোল্টেজ শক্তি হিসেবে ব্যাটারিকে চার্জ করা থেকে শুরু করে নানা রকম কাজ করার উপযোগী করে তোলে।

পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় যে, খুব সাধারণ ওয়াইফাই সিগন্যালের মাধ্যমেও এভাবে ৪০ মাইক্রোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করা যায়। এটি শুধু মোবাইলের ব্যাটারিতে চার্জ দিতেই নয়, একটি এলইডি বা সিলিকন চিপকে পরিচালিত করতেও যথেষ্ট। এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘রেকটেনা’। শুধু ওয়াইফাই নয়, এ ছাড়াও আরো নানারকম রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে সেটাকে শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম রেকটেনা। তবে সেই মাধ্যমগুলোর নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এই পুরো ব্যাপারটিই নতুন এই প্রযুক্তিকে বহনযোগ্য যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির জন্য অনেক বেশি উপকারি করে তুলেছে।

শুধু মোবাইল ফোন নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা কাজেও এটি ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কিছুদিন আগেই একটি বিশেষ ধরনের ওষুধের কথা ভাবতে শুরু করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। সেখানে ওষুধের ভেতরেই মজুদ থাকবে ছোট্ট একটি যন্ত্র। অনেক সময় ভাবা হয়েছে শরীরের ভেতরে টিউমারের অবস্থান ও পর্যায় দেখার জন্য ছোট ল্যাপটপের কথা। তবে এতদিন চিন্তা ছিল শুধু ছোট্ট যন্ত্রটির চার্জ কোথা থেকে আসবে সেটা নিয়ে।

.

এই প্রক্রিয়াটির নাম রেকটেনা; Image Source: thetartan-assets.s3.amazonaws.com

ইতিপূর্বে ভাবা হয়েছিল এমন একটি উপায়ের কথা যেখানে ব্যবহারের সময় শরীরের ভেতরে অবস্থিত যন্ত্রটির চার্জ খুব কম খরচ করা হবে। মনে করা হয়েছিল, এটিই এমন চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের সবচাইতে ভালো উপায়। কিন্তু রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে যন্ত্রকে শক্তি প্রদান করতে পারা এই তারবিহীন প্রক্রিয়াটি যদি সফল হয়, তাহলে রোগীর শরীরের ভেতরে যন্ত্রপাতিকে কাজ করানোটাও অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে যাবে এক নিমিষেই। মানুষের শরীরের যে স্থানগুলোকে খুব ভালোভাবে দেখা সম্ভব হতো না এতদিন, সেটাও এখন দেখা সম্ভব হবে।

.

যন্ত্রটি ১০ গিগাহার্জের চাইতে বেশি মাত্রার যেকোনো রেডিও তরঙ্গকে ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারে; Image Source: www.goodnewsnetwork.org

এই নতুন প্রযুক্তিটি নিয়ে এমআইটি’র টমাস পালাসিয়াস জানান, আমরা কোনো সেতু, রাস্তা, আমাদের অফিসের দেয়াল বা যেকোনো স্থানে যান্ত্রিক নানা প্রযুক্তি রাখলেই হবে না। এই যন্ত্রপাতিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত শক্তি কোথা থেকে আসবে সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। নতুন যে প্রযুক্তিটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি এই কাজটি খুব সহজেই সম্পন্ন করতে পারবে বলে মনে করেন তিনি। আমাদের চারপাশের যন্ত্রপাতিগুলোকে আরো সহজে ব্যবহার করার একটি ভালো উপায় হবে এটি। এই পুরো আবিষ্কারের প্রক্রিয়াটি দুইভাবে বিভক্ত।

অন্যদিকে, মলিবডেনাম ডিসালফাইড ম্যাটেরিয়াল (molybdenum disulfide material) মাত্র তিন এটম পরিমাণ পুরু। এমন সূক্ষ্ম অবস্থাই একে নমনীয় একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করে। এর বৈদ্যুতিক চার্জ গ্রহণের সামর্থ্য বা parasitic capacitance একে বর্তমান প্রক্রিয়ার চাইতে দশগুণ সহজ হতে সাহায্য করে। এতে যন্ত্রটি ১০ গিগাহার্জের চাইতে বেশি মাত্রার যেকোনো রেডিও তরঙ্গকে ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারে। এই যন্ত্রটি চারপাশের বেশিরভাগ জিনিসকে শক্তি প্রদান করতে পারে। এই কাজে এটি ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, সেলুলার এলটিইসহ সম্ভাব্য সব রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

.

এই তারবিহীন প্রক্রিয়াটি যদি সফল হয়, তাহলে রোগীর শরীরের ভেতরে যন্ত্রপাতিকে কাজ করানোটাও অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে; Image Source: images.spot.im

বর্তমানে এই যন্ত্রটির নির্মাণকারী দল আরো বেশি জটিল একটি যন্ত্র তৈরি করতে চলেছেন। যেটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো কয়েকগুণ বেশি সক্ষম হবে। তাদের হিসাব ঠিক থাকলে এই পদ্ধতিকেই আরো জোরদার করে ৩০ গুণ বেশি দক্ষতার সাথে রেডিও তরঙ্গকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। যেটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক চিন্তাকে দূর করে দেবে। আমাদের প্রতিদিনের কাজ হয়ে যাবে অনেক বেশি সহজ। নিজেদের কাজের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। এই কাজটি ঠিক কতটা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে সেটা এখনো দেখার বিষয়।  সুত্রঃ টার্চ ফাইলস।