অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনার ছাড়া জিম!

0
.

অলিতেগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজাচ্ছে জিম। বাইরে ঝুলছে সুঠাম, সুন্দর চেহারার অধিকারী পুরুষ, মহিলার ছবি। পরিবেশও বেশ ঝাঁ–চকচকে। ভেতরে মেশিনের ছড়াছড়ি। জেন ওয়াই থেকে মাঝবয়সী সবাই ছুটছেন সেখানে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনার ছাড়া যেমন খুশি ব্যায়াম করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এবার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনার না থাকা জিমগুলোকে চিহ্নিত করতে পথে নেমেছে কলকাতা পুরসভা। বিশিষ্ট ব্যায়াম বিশারদ ও মিঃ এশিয়া রানার আপ ডাঃ তুষার শীল শুধু স্বাগতই জানাচ্ছেন না, তাঁর কথায়, ‘এটা মনের মতো উদ্যোগ’। তিনি জানালেন, ‘অনেক জিমেই মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো ব্যায়াম করছেন। এটা হয় না। প্রতিটা ব্যায়ামেরই ছন্দ এবং বিজ্ঞান আছে। কিন্তু সেটা দেখানোর কেউ নেই! ফলে ব্যায়াম করে সুস্থ থাকার বদলে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যেটা মানুষের উপকারের জন্য, সেটাই অনেক সময় তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ আন্তর্জাতিকখ্যাতি সম্পন্ন ফিটনেস সেলিব্রিটি ও গুরু’জ ড্রিম জিমের কর্ণধার গুরুপ্রসাদ ব্যানার্জির কথায়, ‘ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন গলিতে গলিতে জিম। এটা যে একটা বিজ্ঞান, সেটাই অনেক সময়ই উপেক্ষা করা হচ্ছে। কতগুলো মেশিন সাজিয়ে দিলাম, আর যে যার মতো শারীরিক কসরত করে গেল, এটা হতে পারে না। প্রত্যেকটা মানুষেরই আলাদা আলাদা শারীরিক গঠন ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া থাকে। যাঁর যতটা প্রয়োজন, সেই অনুযায়ী ব্যায়াম করতে হয়। জিম তো শুধু মাস্‌ল গজানোর জন্য নয়, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্যও। চিকিৎসক ঠিক করে দেন রোগী কী ওষুধ খাবেন, রোগী ঠিক করেন না। তেমনই ব্যায়ামের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনাররা সেটা ঠিক করে দেবেন। পুরসভার এই উদ্যোগ অনেককেই রক্ষা করবে শারীরিক ক্ষতির হাত থেকে।’ তুষার শীলের কথায়, ‘যাঁরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাঁরা ব্যায়াম দেখাতেই পারেন সুস্থ মানুষকে সুস্থ রাখার জন্য। কিন্তু একজন অসুস্থ মানুষ, যাঁর কোনও রোগের চিকিৎসা চলছে, সেখানে তাঁর অসুখ সম্পর্কে না জেনে ব্যায়াম করানোটা কখনই উচিত নয়। একজন প্রশিক্ষককে জানতে হবে কার জন্য কোন ব্যায়ামটা উপযোগী। যেমন কোমরে বা ঘাড়ে ব্যথায় কাতরানো একজন মোটা মানুষের জন্য যে ব্যায়ামটা উপকারী, সেটা আবার একজন উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের রোগীর জন্য উপকারী নয়।’ সৌমেন’স ওয়ার্কআউটের কর্ণধার ও ফিটনেস ট্রেনার সৌমেন দাসের কথায়, ‘জিম বা ফিটনেস সেন্টার কলকাতায় প্রচুর থাকলেও, খুব ভাল মানের ফিটনেস ট্রেনার নেই। একজন হার্টের রোগীর কতটা শরীরচর্চা দরকার বা হাঁটুর ব্যথার রোগীকে কী ব্যায়াম করালে ব্যথা কমবে, সেটা ট্রেনারের জানা উচিত। সবটাই যেহেতু বিজ্ঞান, তাই তার বাইরে গেলেই সমস্যার সূত্রপাত। কলকাতা পুরসভা বা রাজ্য সরকার যদি ট্রেনারদের দিকে বিশেষ নজর দেয়, তা হলে মানুষের উপকারই হবে। একজন চিকিৎসক যদি সার্জারির সময় কোনও ভুল করে ফেলেন তা হলে যেমন রোগীর বাকি জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তেমনই ভুল ব্যায়াম শরীরে নানা সমস্যা ডেকে আনতে পারে।’ হার্টের রোগী জিম করতে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের শংসাপত্র দেখে তবেই তাঁকে জিমে ভর্তি নেওয়া উচিত। এমনটাই মত প্রখ্যাত হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শুভানন রায়ের। তাঁর মতে, ‘আমরা যখন শরীরচর্চা করছি তখন দেখতে হবে একজন রোগী বা সুস্থ মানুষ যেই হোন, তাঁর শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করার ক্ষমতা কতটা। এটা পরিমাপ করার জন্য কতগুলো স্কেল আছে। যেটাকে বর্গ এক্সজর্শন স্কেল‌ বলে। এতে যদি কারও শারীরিক সক্ষমতার মাত্রা ১০ ছোঁয়, তা হলে শরীরচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর ৭–এর বেশি অতিক্রম করা উচিত নয়। অর্থাৎ যতটা ক্ষমতা তার ৭০ শতাংশ পরিশ্রম করা উচিত। যদি ট্রেনাররা তাঁকে বেশি পরিশ্রম করান, তা হলে সার্ডেন কার্ডিয়াক ডেথ বা হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখন বেশিরভাগ মানুষই হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস বা ওবেসিটিতে আক্রান্ত। তাঁদের কীভাবে, কী কী ব্যায়াম করানো দরকার, সেটা না জানলে সমস্যা। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর এখানেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনারের দরকার।’ জিম শুরুর আগে চিকিৎসকের শংসাপত্র বা শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে ডাঃ রায়ের সঙ্গে একমত গুরুপ্রসাদ ব্যানার্জি এবং সৌমেন দাস। গুরুপ্রসাদ ব্যানার্জির কথায়, ‘প্রতিটা জিমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনার থাকা যেমন খুবই দরকার, তেমনই ৪০ ঊর্ধ্ব বা ৪০–এর নিচে যদি কারও শারীরিক সমস্যা থাকে, যেমন রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় লিপিড, ট্রাইগ্লিসারাইড বা উচ্চ রক্তচাপ, তা হলে তাঁদের চিকিৎসকের শংসাপত্র না দেখে জিম করানো উচিত নয়। জিম শুরুর আগে অবশ্যই জানা দরকার মানুষটির কী কী শারীরিক সমস্যা আছে। যদিও এই পরিকাঠামো আমাদের দেশে এখনও খুব একটা নেই বলেই জিম করতে গিয়ে সুস্থতার বদলে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’ সৌমেন দাস জানালেন, ‘জিম শুরুর আগে মানুষটির শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি জানতে হবে তিনি কী ধরনের লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত, ধূমপান বা মদ্যপান করেন কিনা। তারপর ঠিক করা হয় তাঁর ব্যায়াম। খুব লো প্রেশার বা হার্টের সমস্যায় কেউ অনেকক্ষণ ট্রেডমিল করলে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই জিমে শারীরিক কসরত শুরুর আগে যে কোনও মানুষের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে ঠিক করে নিতে হবে তার কী কী ব্যায়াম উপকারী। ’ নিমমিত শরীরচর্চায় হার্টের অসুখের সম্ভাবনা কমে। তবে সেটা কি জিমেই সম্ভব? ডাঃ রায়ের কথায়, ‘জিমই করতে হবে এমন নয়। দৌড়নো, হাঁটা, সাঁতারও ভাল শরীরচর্চা। উপকার একই। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, বাইপাস সার্জারি বা হার্ট অ্যাটাকের পর জিম করতে আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।’ এখন অনেক জিমেই ভর্তির পর শরীরচর্চার বদলে ফুড সাপ্লিমেন্ট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার ঘোরতর বিরোধী তুষার এবং গুরুপ্রসাদ। তুষার শীলের কথায়, ‘যাঁরা পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা কি আদৌ জানেন ওই খাবারগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ? এই ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার কোনও অধিকার নেই তাঁদের। গেলাম ব্যায়াম করে সুস্থ হব বলে, আর ধরিয়ে দেওয়া হল ফুড সাপ্লিমেন্ট, ট্যাবলেট! কোন ট্যাবলেটে স্টেরয়েড আছে, কোনটায় ডোপ হচ্ছে, সেটা না জেনেই এগুলো দেওয়া হয়। এটা তো সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে সুস্থ হওয়ার বদলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’ গুরুপ্রসাদ ব্যানার্জি বলেন, ‘সাপ্লিমেন্ট মানে লাঠি নিয়ে চলা। যখন আর খেতে পারব না তখনই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। যতদিন সাপ্লিমেন্ট ততদিন চেহারা। আমরা জানি না কোনটায় স্টেরয়েড আছে, কোনটা কতটা উপকারী। ফুড সাপ্লিমেন্ট খেয়ে একমাসের মধ্যে রোগা বা মোটা হতে গিয়ে অনেকেই নানা শারীরিক সমস্যা ডেকে আনছেন। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।