অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

হলি আর্টিজান হামলার ৩ বছর : চলতি বছরেই হতে পারে মামলার রায়

0
.

দীর্ঘ দুই বছর পর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশিট দিতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই মধ্যে মামলার ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬০ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে যুক্তিতর্কে প্রবেশ করবে মামলাটি, এরপরই রায়।

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আশা করছেন, আগামী চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে মামলাটি সেই রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে। তাতে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষ এখনো সঠিক তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তবে এ বছরের মধ্যেই মামলাটি রায় দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে মনে করেন তিনিও।

তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিদের হামলায় কেঁপে উঠেছিল গুলশান। হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ সেই হামলায় ইতালির ৯ জন, জাপানের সাত জন ও ভারতের এক নাগরিক এবং বাংলাদেশি দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। জঙ্গিরা জিম্মি করে ওই বেকারির কর্মীসহ আগত অতিথিদের। পরে বিশেষ কমান্ডোর অভিযানে পাঁচ জঙ্গির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে জঙ্গিদের তাণ্ডবের। অভিযান শেষে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে বেকারির বাবুর্চি সাইফুলের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার সহকারী জাকির হোসেন শাওন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।

হামলার দুই বছর পর, গত বছরের ২৩ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম (সিএমএম) আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২১ জঙ্গির মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দিয়ে বাকি আট জনকে অভিযুক্ত করা হয় ওই চার্জশিটে। ২৬ জুলাই সিএমএম আদালত মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বদলির আদেশ দেন। ৮ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান আট আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেন।

ট্রাইব্যুনালের পিপি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী  বলেন, হলি আর্টিজান মামলাটি বর্তমানে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে বিচারধীন। মামলাটি দ্রুত রায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মামলাটি শেষ করার জন্য বিচারক প্রতি মাসে তিন থেকে চারটি তারিখে সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য দিন নির্ধারণ করছেন। এরই মধ্যে ২৯টি নির্ধারিত তারিখে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছেন আদালত। আগামী ২ জুলাইও পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করা আছে।

তিনি বলেন, পুলিশের গুলশান জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আ. আহাদ হলি আর্টিজানে হামলায় আহত হয়েছিলেন। তিনিও মামলার ৫৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

পিপি বলেন, মামলাটিতে অভিযোগ গঠনের পর ২০ থেকে ২২ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে পলাতক দুই আসামি গ্রেফতার হন। পলাতক দুই আসামির পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ লিগ্যাল এইড থেকে অ্যাডভোকেট নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে ওই দুই আসামি নিজস্বভাবে আইনজীবী নিয়োগ করে। এ মামলার প্রতিটি সাক্ষীকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে পিপি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এরই মধ্যে যেসব সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তা আসামিদের দোষী প্রমাণ করা জন্য যথেষ্ট। এছাড়া এ মামলার ছয় জন আসামি আদালতে বিভিন্ন সময়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানেও তারা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তারপরও মামলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া এখনো বাকি রয়েছে। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছি, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দেবেন আদালত।

অবশ্য ভিন্নমত জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, এ মামলার কোনো সঠিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এখন পর্যন্ত উপস্থাপন করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষী আসামিদের নাম বলতে পারেননি। মামলার এজাহারেও কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। আসামিরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত বা সহযোগী ছিল— সে বিষয়েও কোনো সাক্ষী কিছু বলতে পারেননি। এছাড়া মামলার আলামতের সঙ্গে কোনো কিছুরই মিল নেই। রায় হলে আসামিরা সবাই খালাস পাবে বলে আমরা আশাবাদী।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণের প্রতিটি সেশনেই মামলার তদন্তক র্মকর্তা আদালতে হাজির থাকেন। সাক্ষীরা নিজেরাই বলেছেন, তার উপস্থিতির কারণে তারা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।

মামলাটি এ বছরেই রায়ের জন্য প্রস্তুত হতে পারে জানিয়ে আসামিপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, মামলাটি পরিচালনা করতে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি। ফলে মামলাটি এগিয়ে যাচ্ছে। মামলার কার্যক্রমের যে গতি রয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে চলতি বছরের মধ্যেই এই মামলার রায় ঘোষণা করতে পারবেন বিচারক।

গত বছরের আগস্টে মামলাটির চার্জশিট গ্রহণের পর ২৬ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এরপর ২৯ আগস্ট পলাতক আসামি মো. শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদের সম্পত্তি ক্রোক ও তাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন আদালত।

এই মামলার আসামিরা হলেন— অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশিদ ও শরিফুল ইসলাম। আসামিদের সবাই কারাগারে রয়েছে।

এদিকে, মামলাটির চার্জশিট দাখিলের সময় এ ঘটনায় আলোচিত ব্যক্তি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে এই হামলায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

পাঁচ জঙ্গিসহ শেফ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী শেফ শাওনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে দীর্ঘদিন পরে থাকার পর বেওয়ারিশ ঘোষণা করা হয়। পরে লাশগুলো আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।