অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

কোরবানির শিক্ষা ও আমাদের নৈতিকতা

1
551638_10150982115992644_1297844074_n
হাসান মনসুর

কুরবানির আভিধানিক অর্থ আত্মত্যাগ। মূলত মনের পশুত্বকে হত্যা করা এবং মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে একজন মুমিন মুসলমান কে কতটুকু আন্তরিক ও আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে-তা বুঝাতেই এই ঈদ উল আযহা। মহান আল্লাহর নির্দেশে প্রাণ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে আল্লাহর রাহে কোরবাণী করার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন রেখেছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ), যা আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয় হয়েছিল। বর্তমান আধুনিক প্রেক্ষাপট ও প্রচলিত সভ্যতায় এই কুরবানির ঈদ কে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরা হচ্ছে, জাহির করা হচ্ছে নিজের বিত্তের ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানে। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ফেসবুক খুললেই কেবল গরুর ছবি, সঙ্গে তাঁর মালিকের ছবি দেখছি। অনেকে আবার গরুর গায়ে ফটো শপ করে তার দামও বসিয়ে দিয়েছে।প্রতিবেশীদের মধ্যে দেখা যায় তুলনামূলক ভাবে বেশী, ভালো পশু কেনার প্রতিযোগিতা।

14379719_10153881352217644_2857782632881626309_o-1
কোরবানীর পশু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে বিকৃতি প্রচার কতটুকু নৈতিকতা ?

অনেকে অপেক্ষা করে থাকে একজনে কেনার পর তিনি কিনবেন তারটার চেয়ে যেন নিজেরটা দামী বা বড় হয়। তবে ফেসবুকের কোথাও ছাগলের ছবি নেই।হয়ত ছাগল কুরবানি দেওয়াটা আত্মসম্মানের বিষয় ! কোন কোন পোস্টে আবার গরু সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা করা। ফেসবুকের কুরবানির পোস্ট গুলো পড়তে পড়তে মনে হয় কোথায় আত্মত্যাগ ? কোথায় এর শিক্ষা? এতো দেখি রীতিমতো প্রতিযোগিতা, অর্থ-বিত্তের প্রদর্শনী । একবারও আমরা ভাবিনা সেদিন যদি মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সত্যি সত্যি হজরত ইসমাইল (আঃ)এর কোরবানি হয়ে যেত তাহলে আজ সভ্যতা বা ইসলাম ধর্ম থাকতো কিনা? আল্লাহ মহান বলেই এই আনুগত্য ,আত্মত্যাগকে কবুল করে তার পরিবর্তে এটিকে দুম্বায় পরিনত করেছিলেন।

আজ আত্মত্যাগের সকল মহিমা চাপা পরে যায় অর্থের উত্তাপের কাছে। অথচ কিভাবে , কোথা থেকে আমরা তা উপার্জন করছি তা ভাবি না। আরেকজনের টাকায় , অধিকার হরন করে সেই টাকায় লাখ লাখ টাকা দিয়ে কোরবানি করে আল্লাহকে তুষ্ট করা যায় না। কোরবানির ঈদ সমাগত হলেই আমরা পাগল হয়ে যাই কিভাবে বড় গরুর টাকা জোগাড় করবো ।অফিসে ঘুষের মিটার বেড়ে যায় , রাস্তা ঘাটে ট্রাফিক পুলিশ থেকে শুরু করে সবাই শুরু করে চাঁদাবাজি। মান বাঁচাতে যেন গরু একটা কিনতেই হবে । গরু ব্যাপারীরা সারা বছর অর্থ, শ্রম দিয়ে পশুকে লালন পালন করে পথিমধ্যে তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় মাস্তান আর পুলিশে- আবার শহরে ঢুকলে জোর করে নামানো হয় নিজস্ব পশুর হাঁটে। বাধ্য করা হয় তাদের নির্দিষ্ট হাঁটে গরু বিক্রি করতে ।

মানুষের সাথে বেইমানী করছে, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করছে, আরেকজনের জায়গা দখল করছে , হিংস্র পশুর মত খারাপ ব্যাবহার করছে দুর্বলের সাথে এগুলোতে যেন কোন পাপ নেই।কোরবান একটা দিতে পারলেই যেন সব শুদ্ধ । অদ্ভুত আর বিকৃত মানসিকতা। ধর্মের উছিলা দিয়ে এ যেন দেখানো আর মাংস খাওয়ার উৎসব । অনেক শিক্ষিত আর জনপ্রতিনিধিরাও হাসি মুখে দাঁত কেলিয়ে গরুর গলায় ছুরি দেওয়ার রক্তাক্ত ছবি পোস্ট করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।অথচ আমরা অনেকেই জানিনা মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর সব দেশেই আইন করে নিষিদ্ধ জবেহ করার ছবি দেওয়া।

ভুমি অফিসের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী, আর পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়া বখাটে মাস্তান কিভাবে আকস্মিক লাখ টাকায় গরু কিনে কোরবান দেয় -এই প্রশ্ন কেউ করে না, মানুষটা কি করে? কোথা থেকে এত টাকা আসে? ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলে মনে হয় ত্যাগ শিক্ষার উৎসবের বদলে আনন্দ উৎসব হচ্ছে। পবিত্রতম খাবার এই কোরবানির মাংস অথচ অনেকে এই খাবারকে পরবর্তীতে গ্রহন করেন হারাম পানীয় র সাথে, পার্টি দিয়ে। অনেকে কোরবানের পশু কেনার আগে মাংস সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর কিনেন-পশুর সাথে তাল মিলিয়ে কেনা হয় ডিপ ফ্রিজ। রমরমা হয়ে উঠে রেফ্রিজারেটরের বাণিজ্য। ত্যাগ,আবেগ, শিক্ষা যেন এখানে যেন গৌণ।

একবার একজনের সাথে গরু কিনতে হাঁটে গিয়ে দেখলাম তিনি ৮০ হাজার টাকায় কেনা গরুতে কতো কেজি মাংস হতে পারে তার হিসেব কষছেন।কতটা নীচে নেমে গেছি এই “আমরা”। প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে এটা নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি , কোরবানি দেওয়ার পর রক্তাক্ত মৃত পশুর উপর মানুষ রূপী পশুর আরোহণ দেখে। প্রযুক্তির কল্যাণে নিজের আভিজাত্য দেখাতে বা নিজেকে খ্যাতিমান বানাতে গিয়ে আমরা নিজেদের হাস্যকর করে তুলছি। মানুষ কিসে আনন্দ পায় , কিসে আহত হয় এটা বোঝার ক্ষমতা আমরা অনেকেই হারিয়ে ফেলেছি। ইসলাম শান্তির ধর্ম, সাম্যর ধর্ম, পরমতসহিষ্ণুতার ধর্ম-তবে আমরা যেভাবে আমরা ফ্রিস্টাইলে এটিকে নিজের মতো করে-বিকৃত ভাবে পালন করছি তাতে আমাদের আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে। আজকাল এরকমও দেখা যায় ,বাপ মা ছেলেকে অনেক সম্পদ ফ্ল্যাট বাড়ি দিয়ে গেছে, সেই সন্তান কোটি টাকা ব্যাংকে রেখেও শুধু ঝামেলা হবে এটি মনে করে মৃত বাবা মা আর নিজের নামে কোরবানি দিতে চায় না।

ধর্মীয় আচার, প্রকৃত শিক্ষা পায়নি বলেই এই ত্যাগের ঘটনাটিকে স্রেফ ঝামেলা হিসেবে নিচ্ছে আমাদের সেই অভিজাত প্রজন্মের কিছু সন্তান, তাই পারিবারিক ভাবে সন্তানদের শিক্ষা দিতে হবে এই ব্যাপারে। এক সময় ঈদে পর্যটন শহরে কেউ যেত না – সবাই থাকতো ধর্মীয় গাম্ভীর্য নিয়ে এই সময় , কারন হজ্ব ও একই সাথে। আর এখন গরু কেনা, কাটা, বিতরন করা এগুলো থেকে বাঁচতে অনেকে চলে যান পরিবার নিয়ে অবকাশ যাপনে, বাড়ির কেয়ারটেকার বা আত্মীয়কে দিয়ে যান কোরবানির দায়িত্ব। এতোটাই আমরা স্মার্ট আর অভিজাত হয়ে গিয়েছি। উৎসবকে পালন করবো অবশ্যই-তবে ধারন করতে হবে তার তাৎপর্য, তা না হলে এর কোন গুরুত্বই থাকে না। যেন মেকি আর লোক দেখানো ।

লেখক: হাসান মনসুর , রাজনৈতিক কর্মী, চট্টগ্রাম।

১ টি মন্তব্য
  1. Mdjahangir Alam বলেছেন

    সামাজিক অবক্ষয়ের কারনে অাজ পবিত্র কোরবানীর পশুকে নিয়ে যে ভাবে মোবাইল ফোনে চবি দেখা যাচ্ছে ৷