অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

টাকা ছাড়া পুলিশে চাকুরী হয় না!

1
11828619_10153079995811033_4428282777948124421_n
ইশতেয়াক আহমদ জয়।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কক্সবাজারের একটি ইউনিয়নের নেতার জন্য চাকুরির আবেদন জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইশতেয়াক আহমদ জয়। তার ফেসবুকে পাতায় দেয়া এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে এ আবেদন জানান। একই স্ট্যাটাসে ছাত্রলীগের এ সভাপতি পুলিশের কনেস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগও করেন। আর টাকার অভাবে ছাত্রলীগের কারো চাকুরি না হলেও জামায়াত-বিএনপির লোকজন পুলিশের চাকুরি পাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

কক্সবাজার ছাত্রলীগ সভাপতির স্ট্যাটাসটি ঘিরে নানা মহলে চলছে আলোচনা-মন্তব্য।

screenshot_1
ইশতেয়াক আহমদ জয়ের সেই ফেসবুক স্ট্যাটাস।

জয় তার স্ট্যাটাসে লেখেন, “গত ২১ মাসে আমার শহর কক্সবাজার জেলায় পুলিশের ৩টি নিয়োগ হয়েছে। সারা বাংলাদেশে কি অবস্থা জানি না, তবে কক্সবাজার এর অবস্থা ভয়াবহ। এই ভয়াবহতা আমাকে কষ্ট দেয়, নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে হয়।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি ও রাশেদ পুলিশের সেপাহী পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য (২৭ জানুয়ারি, ২০১৫) ছাত্রলীগের ৮ জন নেতা-কর্মীর তালিকা করি। এই ৮ জনের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য আমরা বিবেচনায় রেখেছিলাম যে বিষয়গুলো তা হলো: ১) ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী, ২) মেধাবী, ৩) দরিদ্র, ৪) উচ্চতা, শারীরিক গঠন ও বয়স। চাকরীটা খুবই দরকার এমন ৮ জনের তালিকা এসপি বরাবর দেওয়ার পরও দেখা গেলো তাদের কারও চাকরী হলো না। চাকরী হলো বিএনপি জামায়াত কেন্দ্রীক অনেকের। এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত হয়ে এসপি কে ফোন দিলাম আমি ও রাশেদ দুইজনেই। কিন্তু তিনি আমাদের ফোন ধরেন না। আমরা বেশ কয়েকবার দেখা করতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। অনেকবার চেষ্টা করার পর এসপি সাহেব আমাদেরকে দেখা করার জন্য একটা সময় দিলেন। সময়মত আমি আর রাশেদ এসপি অফিসে গেলাম। আমরা উনার রুমে ঢুকতেই দেখি যে, জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা আর উনি রুমের মধ্যে গল্প করছে ও সিগারেট ফুকছেন। ছাত্রলীগের কারও চাকরী কেনো হলো না আর বিএনপি জামায়াত পন্থীদের কেনো চাকরী হলো এরকম প্রশ্ন করায় এসপি সাহেব জবাব দিলেন: ছাত্রলীগের চাকরি হতে হবে এরকম কোন নিয়ম নাই। যারা যোগ্য তাদের চাকরী হইছে। এখন তারা বিএনপি করে, নাকি জামায়াত করে, নাকি অন্য কিছু করে তা আমার দেখার বিষয় না।’ এসপির এরকম বয়ানের পর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শুরু করলেন আরও অন্যরকম ভয়ানক বয়ান, যে বয়ানে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন। বেশি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বের হয়ে এলাম।

তিনি আরো লেখেন, এরপর ৩রা ডিসেম্বর ২০১৫ তে পুলিশের নিয়োগ হয়েছে, আমি তার ধারে কাছেও ছিলাম না। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা কর্মী সুপারিশ নিয়ে আসে, আমি এড়িয়ে যাই। অনেকে এরকম বলে: ‘লিডার আপনি চেষ্টা করলেই তো পারবেন।’ এই কথা শুনেও আমি না শুনার ভান করে থাকি। আমি তো জানি আমার বা আমার সেক্রেটারির কোন সুপারিশে কোন কাজ হবে না। কাজ হবেই বা কেন? আমাদের সুপারিশের সাথে তো কোন টাকার বান্ডিল থাকে না। আর ছাত্রলীগ করা ছেলে মেয়েরা কেনো দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় টাকার বিনিময়ে চাকরী করবে? এর চেয়ে তো বিএনপি জামায়াতের ছেলেদের থেকে টাকা নিয়ে চাকরী দেওয়া ভালো।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তে পুলিশের কনস্টেবল পদে আরও একটি নিয়োগ হয়। ১৫ বা ১৬ সেপ্টেম্বর আমার কাছে মোহাম্মদ আবু রাশেদ নামের এক ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতা দেখা করতে আসে। চাকরীর প্রসঙ্গ শুনেই আমি তাকে চলে যেতে বলি এবং নিজের অপারগতার কথা বলি। পরের দিন সে তার বাবাকে নিয়ে আমার কাছে আসে। কথা বলার এক পর্যায়ে তার বাবা কেঁদে ফেলে, কান্না জর্জরিত হয়ে আবু রাশেদের পরিবারের কষ্টের কথা শুনি। আবু রাশেদের বাবা আবুল বাশার, তিনি মূলত লবনচাষী। অন্যের জমিতে লবন চাষ করে। তার মা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। কাঁদতে কাঁদতে আবু রাশেদের বাবা আমার কাছে চাকরীর জন্য আকুতি করেন। আমি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম বলি এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলি। সে যোগাযোগ করলো কিন্তু এইখানে মূল সমস্যা টাকা। টাকা ছাড়া চাকরী হবে না। ছাত্রলীগ, শিবির, ছাত্রদল মূলকথা না, মূলকথা হলো টাকা। কতো টাকা? মাত্র তিনলাখ। আওয়ামী লীগ নেতা জানালেন তিনলাখ টাকা হলে চাকরী হবে। আবু রাশেদ বাড়ি ছুটলো। অনেক কষ্টে জোগাড় করলো ৬৩ হাজার টাকা। কিন্তু ৬৩ হাজার টাকায় কে দিবে চাকরী? এতোই সহজ নাকি? আওয়ামী লীগ নেতা তাকে বললো, কমপক্ষে দুইলাখ টাকা জোগাড় করতে পারলেও তাকে চাকরী দেওয়া যাবে এসপি সাহেবকে রিকোয়েস্ট করে। এইটুকু উপকার আওয়ামী লীগ নেতা করতে রাজী, যেহেতু আবু রাশেদ ছাত্রলীগ করে।

ইশতেয়াক আহমদ আরো লিখেছেন, আবু রাশেদ ফিরে আসে আমার কাছে। আমি কিছু বললাম না। শরীর খারাপ লাগছে, পরে কথা বলবো, অন্যদিন আসো এইসব বলে তাকে বিদায় দিয়ে দিলাম। পরীক্ষার দিন ফিটনেসে আবু রাশেদ টিকলো। কিন্তু রিটেনে টিকলো না। আমারে ফোন দেয় বারবার কিন্তু আমি ফোন ধরি না। ফোন ধরে কি বলবো? কোন মুখে তার ফোন ধরবো?

এরপর আমি একটা জরুরী কাজে ঢাকা আসি। ঢাকা থেকে কক্সবাজার ফিরি গতকাল। বাসার সামনে গিয়ে দেখি আবু রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে। আমার পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো সে। কোনভাবেই পা ছাড়ে না। কিছু বলেও না, পাও ছাড়ে না। প্রায় ৫ মিনিট পরে কোনভাবে পা ছাড়ালাম কিন্তু কান্না আর বন্ধ হয় না। এদিকে এই পরিস্থিতি দেখে আশেপাশে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। আমি তাকে বাসায় ঢুকালাম। সে আমার হাতে একটা বান্ডিল দিয়ে বললো, ‘ভাই আমারে যেকোন একটা চাকরী দিয়ে দেন ভাই। আমার চাকরী খুব দরকার। চাকরী না হলে আমি মরেই যাবো। সুদে টাকা আনছি ভাই। দরকার হলে আপনার বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে আমারে রাখেন ভাই।’

আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। মাঝেমধ্যে শ্বাস দ্রুত উঠানামা করে। আমার শ্বাসকষ্ট শুরুহলো। আমি দ্রুত ওর হাতে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সাতদিনের মধ্যে তোমার যেকোন একটা চাকরীর ব্যবস্থা করবো। কথা দিলাম। প্লিজ এখন যাও, আমার শরীর ভালো লাগছে না।’

সে চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি একজন চাকরিদাতাকে । আবু রাশেদ পরম নির্ভরতায় তার ভয়ানক দু:সময়ে আমার পা ধরে চাকরীর জন্য মিনতি করলো। আমি তো কথা দিলাম তাকে। কিন্তু আমার তো কোন ক্ষমতা নাই। আমি এখন আমার মুখ বাঁচাতে কার পা ধরে মিনতি করবো? আছেন কেউ ভাই বা বোন? যার পা ধরে আমি কাঁদবো আর তার হাতে ৬৩ হাজার টাকা তুলে দিবো যার বিনিময়ে সে আমার আবু রাশেদকে একটা চাকরী জোগাড় করে দিবে।

ফুটনোট: আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর তিন টি নিয়োগে কক্সবাজার জেলা থেকে(নারী/পুরুষ) উভয় মিলে কন্সটেবল পদে চাকরি ৪২৬ জন পুলিশ নিয়োগ হয়।

অথচ এমন হতভাগা এক ছাত্র প্রতিনিধি আমি যাদের কাউকেই আমি চিনি না। নাজমুল ভাইয়ের কথাটি মনে পড়তেই নিজের অজান্তে চোখের কোনে জল এসে পড়েছে।ছাত্রলীগ এতিমদের সংগঠন। একমাত্র প্রানপ্রিয় নেত্রী ছাড়া আমাদের কেউ খবর রাখে না।”

ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতেয়াক আহমদ জয় জানান, পুলিশের নিয়োগে টাকার লেনদেনটি অনেকটা প্রকাশ্যে। ছাত্রলীগ টাকা দিতে না পারলেও জামায়াত বিএনপিরা ঠিকই টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে নিচ্ছে। এতে ব্যর্থ এক নেতার জরুরী চাকুরিটি কিভাবে দেবেন তিনি বুঝতে পারছেন না।

১ টি মন্তব্য
  1. Sma Razzak বলেছেন

    দু’হাতে টাকা কামানোরা নিশ্চিত সুযোগ যেখানে, সেখানে টাকা না দিয়ে চাকরী পাওয়ার আশা করাটাও বোকামী !