অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

মহিউদ্দিন চৌধুরীর বকা দেয়ার স্রোতে ছিল কর্মীদের প্রতি ভালোবাসা”

0
শাম্মী তুলতুল:

প্রতিটি মানুষের কোন না কোন গুণ থাকে।কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ খুব কম সংখ্যক মানুষেরই থাকে।একজন মানুষ তার চলনে বলনে সবার নজর কাড়তে সক্ষম।আর জনপ্রিয় হওয়া মানে জনতার প্রিয় অসাধারণ তো আছেই তবে সাধারণ মানুষের প্রিয় হওয়া মানেই জনপ্রিয় ।এমন একজন ব্যক্তি মহিউদ্দিন চৌধুরী।একজন লেখক হিসেবে নই আমি উনাকে দেখেছি খুব কাছ থেকে।পারিবারিকভাবে।চলে যাই সেই পাকিস্তান পূর্বে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর পিতা শ্রদ্ধেয় হোসেন আহমেদ চৌধুরী একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন।তিনি রাউজান নিবাসী ডাক্তার এজহারুল ইসলামকে পড়াতেন।যখন এজহারুল ইসলাম ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীতে।আর হোসেন আহমেদ ছিলেন নবম শ্রেণীতে।সেখানে একজন লজিং শিক্ষক ছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে হোসেন আহমেদ রেলওয়ের কর্মকর্তা ছিলেন।এই হোসেন আহমেদ আর মা বেদুরা বেগমের ঘর আলোকিত করে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন।

.

ছোট বেলা থেকেই যে শিশু ছিল তুখোড় আর মেধাবী।তার বড় হওয়ার সাথে সাথেই অল্প বয়সেই তাঁর ব্যক্তিত্যের ছাপ ফুটে ওঠে।নেতৃত্ব দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায় কিশোর বয়সেই।

এক সময় হোসেন পরিবার আর এজহার পরিবারের সঙ্গে বন্ধন হয় অটুট।ছাত্র- শিক্ষক বিবাহের পর তাহাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে গড়ে ওঠে সখ্যতা,বন্ধুত্ব, প্রাণের বন্ধন। ১৯৬৭ রাউজান কলেজে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা কাজী শাহজাহান বাহার চৌধুরী।তিনি রাউজান কলেজে প্রথম ছাত্রলীগের জন্ম দেন।পরবর্তীতে কাজী শাহজাহান ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির পদে আসীন হন। আর সভাপতি হন মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম। তারা যখন ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী ছাত্র রাজনীতিতে পদার্পণ করেন।বয়স ১৫/ ১৬ হবে।যেকোনো মিছিল মিটিং তাঁর নজর কাড়তো। ঠাই দাড়িয়ে থাকতেন।মন দিয়ে শুনত প্রতিটি মিটিং এর বক্তব্য।সিনিয়রদের অনুসরণ করতেন, শ্রদ্ধা করতেন।প্রতিটি মানুষের বড় হওয়ার পেছনের গল্প বড়দের শ্রদ্ধা তাদের কথার বাধ্য হওয়া।তাদের নেতৃত্বকে ফলো করা।এমনি মার্জিত ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

কাজী শাহজাহান যখন গ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী শহরে ছাত্রলীগকে শক্ত অবস্থানে নিতে সহযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের তুলনায় ভোটের ব্যবধানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। তিনি দেশ স্বাধীনতার পর থেকে মৃত্যু অবধি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কয়েক দফায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নগর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন।তেমনি এক সময় তিনি হয়েছেন চট্টল বীর।জনতার নেতা।জনগণের নেতা।হয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন সংগ্রামী নেতা।প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী একেবারে তৃণমূল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন।এ কারণেই বর্ষীয়ান এই নেতা তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করতে সফল হয়েছিলেন খুব সহজেই।
তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শ্রমজীবি মানুষের সাথে রাজনীতি করেছেন। শ্রমিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের সাথে ছিলেন জড়িত। মেয়র থাকাকালীন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর বেডরুম পর্যন্ত সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ৯৬-এ তিনি একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মুহুর্তের মধ্যে সারা চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। প্রশাসন ভেঙে পড়েছিল।”

রাজনীতির পাশাপাশি মহিউদ্দিন চৌধুরী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, যার মধ্যে দিয়ে তাঁর একটা বাড়তি পরিচয় গড়ে উঠেছিল।

”যখনই মানুষ দু:খ দুর্দশার মধ্যে পড়েছে, তিনি কখনো মানুষকে ফেলে যাননি। ১৯৯১ এর সাইক্লোনের সময় বাড়িঘর হারা মানুষকে শহরে তুলে এনে সেবা করেছেন। এটা তাঁর একটা টার্নিং পয়েন্ট এই কথাটি বলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছের মানুষ তার আত্মীয় তালতো ভাই সমাজসেবক আবু মোহাম্মদ খালেদ।
তিনি যখন চট্টগ্রাম শহরের মেয়র তখন ভূমিকম্পে শহরের একটি দালানের নিচে ৬-৭ জন চ্যাপ্টা হয়ে মারা যায়। তখন ডোমরা পর্যন্ত দুর্গন্ধের কারণে এগুলোর কাছে যেতে চাইছিল না। মহিউদ্দিন চৌধুরী অবলীলায় সেই লাশগুলো তুলে আনেন ও তাদের দাফনের ব্যবস্থা করেন। আন্দোলন সংগ্রামেও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি লড়াই করেছেন।এজন্য মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন খুব সহজেই।

মহিউদ্দিন চৌধুরী শুধু চট্টগ্রামে নয় পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন ১৯৯৪ সালে, যখন তিনি প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। সেসময় তাঁর সাথে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন মঞ্জুর আলম, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন। মঞ্জুর আলমের দৃষ্টিতে মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনীতির পাশাপাশি মেয়র হিসেবেও সাফল্য দেখিয়েছেন।

উনার মেধা দিয়ে কাঙ্খিত উন্নয়নের লক্ষ্যে উনি অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছিলেন, সফলও হয়েছেন। বেসিক সেক্টরে, স্বাস্থ্য সেবাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে। একজন সফল মেয়র ছিলেন তিনি। আর গণমানুষের নেতা ছিলেন। যখনই সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ হয়েছে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করেছেন।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বলছেন সেই ঘটনার প্রতিবাদে চৌধুরী সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছিলেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী তার নিজের চিন্তা প্রকাশ করার জন্য অনেক সময় নিজের দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও গিয়েছেন এবং ফলে তাকে বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছে।যখন ভাবতেন একটা কাজ জনগণের উপকারে তখন তিনি অন্য কিছু মাথায় আনতেন না।দলের কেউ পছন্দ না করলেও তিনি তা গুরুত্ব দিতেন না।সবসময় জনস্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।তাইতো হয়েছে গণনেতা।তার বোকা দেওয়ার স্রোতেও ছিল তার কর্মীদের প্রতি এক প্রকার ভালোবাসা।যেটা এক প্রকার গালি হলেও ওনার মুখে ছিল সেটা বুলির মতো।জনগণের কাছেও ছিল সুন্দর বুলি।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমসাময়িক অনেক রাজনীতিবিদ মন্ত্রীত্ব কিংবা দলের সিনিয়র নেতার পদ পেলেও তিনি সবসময় নিজেকে চট্টগ্রামের রাজনীতির সাথেই যুক্ত রেখেছন।আমাদের মতো হাজার হাজার তরুণরা উনার নীতি- নৈতিকতার অনুসারী।বর্তমান প্রজন্মের জন্য জানান দিয়ে গেছেন গেছেন নিজের কর্ম দিয়ে হুট করে এসে একদিনেই নেতা হওয়া যায়না। নেতা হতে অনেক সহ্য, ধৈর্য,অপ্রস্তুত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।

সর্বশেষে গৌরবের বিষয় তিনি আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন।যখন ওনার মৃত্যুর খবর শুনি তখন বুকে মোচড় দিয়ে,চোখ ছলছল করে অশ্রু গড়িয়ে পরে।মনে মনে বললাম, আর কয়েকটি বছর তো আপনি থাকতে পারতেন।জনগণকে ,নতুন প্রজন্মকে রাজনীতির শিক্ষা দিয়ে যেতে পারতেন।কিন্তু দুঃখ ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাত সংগ্রামী এই নেতা কিডনিসহ বিভিন্ন জটিলতায় দীর্ঘদিন ভোগার পর চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ৩:৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

তিনি আজীবন যুগ যুগে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সকলের হৃদয়ে অবস্থান করবেন।অবস্থান করবে সবার হৃদয়ে তার দীর্ঘদিনের জীবনচলা।উনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি প্রতিটি ক্ষণে।প্রতিটি দোয়ায় তিনি থাকবেন, আছেন। এই একটি জিনসই তার জান্নাতে পৌঁছাবে। আমীন।

লেখক: শাম্মী তুলতুল।
লেখক, ঔপন্যাসিক,সাহিত্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু একাডেমি কেন্দ্রীয় কমিটি।