অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

উপবৃত্তির ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে কেরানীগঞ্জের শিক্ষা অফিসার

0
.

শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে গত ৭ মাস আগেই কাগজে কলমে তা বিতরণ দেখিয়েছেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাজেদা সুলতানা। শুধু তাই নয়, মিথ্যা তথ্য দিয়ে যে ভুয়া বিল ভাউচার জমা দিয়েছেন সেখানেও শেষ পর্যন্ত ১৪ লাখ টাকার হিসাব মেলাতে পারেননি তিনি। মিথ্যা তথ্যসম্বলিত ভুয়া বিল ভাউচারেও ১২ লক্ষ ১৭ হাজার ৪৭৫ টাকা বিতরণের হিসাব দেখিয়েছেন মাজেদা সুলতানা। উপজেলার ১২৮ টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭ টি বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি বিতরণের এই ভুয়া হিসাব দিলেও বাকী ৩১ টি বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি বিতরণের কোনো ভুয়া হিসাবও দিতে পারেননি তিনি। দাখিল করা উপবৃত্তি বিতরণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র ও ব্যাংকের হিসাব বিবরণী থেকে এ তথ্য পেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা, ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয়।

এদিকে শিক্ষা অফিসারকে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ১৪ লাখ টাকা আত্মসাতে সহযোগিতা করায় কেরানীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক ফখরুল আলমকে বদলির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১৪ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ইফতেখার হোসেন ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এই বদলির আদেশ জারি করা হয়। কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক তদন্তে কেরানীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ফখরুল আলমের অপরাধের সত্যতা পাওয়ায় তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে গোপালগঞ্জ পিটিআই অফিসে বদলি করা হয়েছে। যদিও বদলির নির্দেশনায় প্রশাসনিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে বদলিকৃত কর্মস্থলে তাকে যোগদান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় ২০ জুলাই থেকে তাৎক্ষণিক কর্মবিমুক্ত হিসেবে তাকে গণ্য করা হবে বলেও বদলি নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাজেদা সুলতানা কর্তৃক উপবৃত্তির ১৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বিভাগীয় কার্যালয়। এ কমিটিকে সরেজমিন তদন্ত করে ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা বিভাগীয় অফিস। প্রাথমিক শিক্ষা, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ইফতেখার হোসেন ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত ওই আদেশে শিক্ষা অফিসার মাজেদা সুলতানার উপবৃত্তি টাকা আত্মসাতের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।

এর আগে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত ও শিক্ষা অফিসার মাজেদা সুলতানার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালকের কাছে আবেদন করেন অভিভাবকরা। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৯ জুলাই কেরানীগঞ্জ উপজেলার বিগত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের উপবৃত্তি বিতরণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রসহ ব্যাংকের হিসাব বিবরণী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে দাখিলের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

দাখিলকৃত কাগজপত্র ও হিসাব বিবরণীতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের উপবৃত্তির টাকা ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে মর্মে দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভিভাবকরা এখন পর্যন্ত উপবৃত্তির কোনো টাাকাই পাননি। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের দাখিলকৃত হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, কেরানীগঞ্জ উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের উপবৃত্তির প্রকল্পভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেখানো হয়েছে মোট ৯৭ টি, সুবিধাভোগী অভিভাবকদের সংখ্যা ১৯৯৮, সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯৭২, বরাদ্দকৃত টাকার পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৭৫ টাকা, বিতরণকৃত টাকার পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১২ লক্ষ ১৭ হাজার ৪৭৫ টাকা এবং উদ্বৃত্ত টাকার পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৬০০ টাকা। উদ্বৃত্ত ১৬ হাজার ৬০০ টাকা ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি সরকারি কোষাগারে জমা দেখানো হয়েছে এবং প্রকল্প কার্যালয়ে জমাপ্রদানকৃত বিল ভাউচার অনুযায়ী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাজেদা সুলতানা ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি বিল ভাউচার স্বাক্ষর করে প্রকল্প অফিসে জমা দিয়েছেন। কাগজে কলমে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারির পূর্বে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই ১২ লক্ষ ১৭ হাজার ৪৭৫ টাকা উপবৃত্তি বিতরণ করা হয়েছে দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এর ৭ মাস পরেও অর্থাৎ চলতি বছরের ১০ জুলাই পর্যন্ত কোনো অভিভাবকের কাছেই উপবৃত্তির টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এমনকি এই টাকা বিতরণের জন্য কৌশলে ৬ জন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারকেও সম্পৃক্ত করা হয়নি।

উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েপ্রাথমিক শিক্ষা, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ইফতেখার হোসেন ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত ওই আদেশে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে একাংশে বলা হয়, জনাব মাজেদা সুলতানা, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কেরানীগঞ্জ এর বিরুদ্ধে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে উপবৃত্তির প্রায় ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা সংক্রান্ত একই উপজেলার বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিভাবক কর্তৃক অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়াও একই উপজেলার ৫ জন প্রধান শিক্ষক কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি অনুযোগপত্র পাওয়া যায়। প্রাপ্ত অভিযোগ ও অনুযোগপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, ৯ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক কার্যালয়ের চিঠি পাওয়ার পর করোনা মহামারির মধ্যেই গত ১৩ জুলাই ২০২০ তারিখ বেলা আড়াইটায় আমবাগিচা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার একটি জরুরি সভা আহ্বান করেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকরা সভায় উপস্থিত হন।

এই সভায় উপজেলা শিক্ষা অফিসার তার দপ্তরের উচ্চমান সহকারী ফখরুল আলম ও অফিস সহায়ক মনসুর আহমেদকে সাথে নিয়ে উপস্থিত প্রধান শিক্ষকদেরকে বিদ্যালয় অনুযায়ী তালিকাসহ প্রত্যেক প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর রেখে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের মোবাইল ব্যাংকিং থেকে বাদ পড়া অভিভাবকদের নগদ অর্থ নিতে বলেন এবং তিনি নিজেই বিতরণের তারিখ ৭ মাস পিছিয়ে ২৯/১২/২০১৯ নির্ধারণ করে সিডিউল করে দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে প্রধান শিক্ষকগণ টাকা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। অনুযোগপত্রে প্রধান শিক্ষকগণ আরো জানান, অভিভাবকদের অর্থ বিতরণের তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ থাকায় বিষয়টি তারা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিকে জানালে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ওই টাকা বিতরণ করতে নিষেধ করেন। এছাড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাজেদা সুলতানা কর্তৃক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বিষয়টি তিনি বারংবারই এড়িয়ে যাচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় উপবৃত্তির টাকা রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশের মাধ্যমে মোবাইলের (অনলাইনে) শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বিতরণ করার কথা। কিন্তু তথ্যগত ত্রুটির কারণে যেসকল অভিভাবকদের মোবাইলে দেয়া সম্ভব হয়নি সেসকল অভিভাবকদের নিকট ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা অফলাইনে বিতরণের জন্য একসঙ্গে প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা নগদ উপজেলা শিক্ষা অফিসার , কেরানীগঞ্জ এর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসার , কেরানীগঞ্জ তার দপ্তরের উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক মো: ফখরুল আলমের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ডেকে পেছনের তারিখ দিয়ে বিল ভাউচারে সই নিয়ে টাকা উত্তোলন করে মাজেদা সুলতানার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা করেন।

উপপরিচালকের তদন্তের আদেশ সম্বলিত চিঠিতে আরো বলা হয়, উপজেলার ১২৮ টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭ টির বরাদ্দ বর্ণিত হয়েছে বাকী ৩১ টি বিদ্যালয়ে বরাদ্দে প্রধান শিক্ষকদের দিয়ে ভুয়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে রেকর্ড প্রস্তুত করা হয়েছে মর্মে জানা যায়।