অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের “বঙ্গবন্ধু টানেল” নির্মাণ শেষ পর্যায়ে

0
.

সাইফুল ইসলাম শিল্পী:

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম নির্মিত হল স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল (সুড়ঙ্গ সড়ক)। নির্ধারিত সময়ের আগেই বর্তমান সরকারের অন্যতম এ মেগা প্রকল্প শেষ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের প্রায় ৭৩ ভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। করোনাকালেও টানেল নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলেছে। একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি কর্মযজ্ঞ।

টানেলের প্রথম টিউবের ভেতরে গাড়ি চলাচলের জন্য পিচঢালা রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে দ্বিতীয় টিউব তৈরির কাজও শেষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে পতেঙ্গা প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ এই চ্যানেলের খননকাজ শেষ হয়। পূর্ব ঘোষণা অনু্যায়ী, চ্যানেলটির মুখ খুলে দেয়া হচ্ছে আজ শুক্রবার।

আগামী বছরের শেষ নাগাদ বহুল প্রত্যাশার এই টানেলের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হতে পারে আশা করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এই টানেল দিয়ে প্রথম বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। কয়েক বছরের মধ্যে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখে পৌঁছবে। এসব গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ কন্টেইনারবাহী ট্রেইলর, বিভিন্ন ধরণের পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস। ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ধরনের ছোট গাড়ি।

.

৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মূল টানেলের সঙ্গে উভয় প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হচ্ছে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার। চারলেনের টানেলে দুটি টিউব থাকছে। টানেলের ভেতরে দুটি টিউবে ওয়ানওয়ে গাড়ি চলবে। একটি দিয়ে শহর থেকে আনোয়ারামুখী গাড়ি যাবে, অপরটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে শহরমুখী গাড়ি আসবে। একটি টিউব ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট চওড়া এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট।

জানা যায়, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আনোয়ারা প্রান্ত থেকে টানেলের দ্বিতীয় টিউব নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রথম টিউব থেকে ১২ মিটার দূরে নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতীয় ও শেষ টিউবটি। মাটির ১৮ মিটার থেকে ৪৩ মিটার নিচ দিয়ে যাবে টানেল বোরিং মেশিন। এছাড়া টানেলের শক্ত দেয়াল হিসেবে ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট স্থাপন করা হবে দুটি টিউবে।

চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেলের সেগমেন্টগুলো তৈরি হচ্ছে। ওখান থেকে সেগমেন্ট জাহাজে করে এনে তলদেশে স্থাপন করে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ৮টি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি করে। বর্তমানে টানেল নির্মাণে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। চীন থেকে সেগমেন্টসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র আনার স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে ১০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট স্থাপন করে প্রথম টিউব তৈরি করা হয়েছে।

.

কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী পাঠক ডট  নিউজকে বলেন, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সড়ক তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যে টানেলের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত একটি টিউবের নির্মাণ আগেই শেষ হয়েছে। আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আরেকটি টিউবের কাজও গতকাল শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের একটি ইতিবাচক দিক হলো, এর মেয়াদ ও ব্যয় বাড়াতে হয়নি। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ হচ্ছে। তবে আগেও শেষ হয়ে যেতে পারে।

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, কাজের গতি বাড়াতে জনবল ও যন্ত্রপাতি বাড়ানো হয়েছে। দ্রুতগতিতে চলছে কাজ। প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। আগামী বছরের শেষ দিকে যাতে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করে, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রায় ৭৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যার মধ্যে দুই সুড়ঙ্গের খননকাজই ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সুরঙ্গ খনন শেষ হওয়ায় আনুসাঙ্গিক বাকি কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হবে বলে আশাবাদী তারা।

এর আগে গত ৫ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, নির্মাণকাজ শেষে আজ শুক্রবার (৮ অক্টোবর) রাতে বঙ্গবন্ধু টানেলের দ্বিতীয় চ্যানেলের মুখ খুলে দেওয়া হবে। আগেই টানেলের প্রথম চ্যানেলের মুখ খুলে দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যে দুই চ্যানেলেরই নির্মাণকাজই শেষ হবে। এ সময় তিনি আরও জানান, আগামী বছরের ২২ ডিসেম্বর টানেল চালুর কথা ছিল। এখন মনে হচ্ছে এরও আগে এটা চালু করতে পারবো।

.

এদিকে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পে দ্রুতগতিতে চলছে আনোয়ারা অংশের সংযোগ সড়কের কাজ। সড়ক ও টানেলকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার মানুষ। কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন (ক্রসিং) থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সড়কটি ৬ লাইনে প্রশস্ত হচ্ছে। বর্তমানে দুই লাইনের ১৮ ফুটের সড়কটি হবে ১৬০ ফুট। সাড়ে ১১ কিলোমিটার এই সড়ক নির্মাণে ব্যয় হবে ২৯৫ কোটি টাকা।

মূলত কর্ণফুলীর তলদেশে বাস্তবায়নাধীন টানেলের সংযোগ সড়ক হিসাবে ব্যবহার ও গাড়ির অতিরিক্ত চাপ সামলানোর জন্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রশস্ত এই সড়ক। বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর চিত্র।

আনোয়ারা উপজেলার বারশত ইউপি চেয়ারম্যান এম.এ কাইয়ূম শাহ্ বলেন, দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু টালেন বড় প্রকল্প। এটির কাজ শেষ হলে আনোয়ারার মানুষ উপকৃত হবে। তেমনি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষদেরও।

তিনি বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বড় পর্যটনকেন্দ্র পারকি সমুদ্র সৈকত। সৈকতের পর্যটকদের জন্য যদি টালেন সড়ক ব্যবহারের জন্য একটি সংযোগ সড়ক করে দেয়া যায়, তবে ঢাকাগামী পর্যটকদের সৈকতে আসা সহজ হবে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পরিচালিত বঙ্গবন্ধু টানেলের চারলেইন ১০ কি.মি. সড়কের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। টানেলের টিউবসহ ৩০ মিটার প্রস্থ এ সড়কে কাফকো সেন্টার-কান্তিরহাট থেকে জেলেঘাটা পর্যন্ত ৭৫০ মিটার ফ্লাইওভার হবে। এ সড়কের দু’পাশে ড্রেন নির্মাণের পাশাপাশি সবুজায়নের ব্যবস্থাও রয়েছে।

৩০ মিটার প্রস্থ সড়কের মূল অংশ হবে ২৪ মিটার। এ সড়কের প্রথম অংশ হতে ৪ মিটার উচ্চতা হয়ে পরবর্তীতে ২ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা থাকবে। সড়কটি তৈরিতে প্রথম লেয়ার বালি ফিলিং, পিভিডি ওয়াড, সেন্ট ফিলিং ও পাইলিং, এরপর ওপরের স্তরে জিও গ্রেড বেড বসানো হবে। এরপর একইভাবে ২য় স্তরের কাজও চলবে।

তথ্যমতে, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)। এ টানেলের মধ্যদিয়ে দুই পাড়ের সেতুবন্ধন রচিত হবে। শিল্পায়নের ফলে এ অঞ্চলের লাখো মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। টানেলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে টানেলের পূর্ব প্রান্তে প্রায় ৫ কিলোমিটার ও পশ্চিম প্রান্তের ৭২৭ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলার যোগাযোগ রক্ষা পাবে।

প্রসঙ্গত, চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে গড়ে তুলতে নগরীর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর এই টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।

৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়। বাংলাদেশ সরকার ও চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক যৌথভাবে অর্থায়ন করছে। চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি নির্মাণ করছে। চীন সরকার এ টানেল নির্মাণের জন্য দেশটির প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়।

এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকল্পে ঋণ হিসেবে চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করবে। নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। ২০২২ সালের মধ্যে টানেলটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

দুই টিউবের এই টানেল নির্মাণকাজ শেষ হলে চারলেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সিটি আউটার রিং রোড দিয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলে প্রবেশ করে আনোয়ারা প্রান্তে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়কের চাতুরী চৌমুহনী পয়েন্টে ওঠা যাবে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে।

এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ কমবে। এছাড়া পূর্ব প্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্ব প্রান্তে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।