অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

বিএনপি’র রেইনবো নেশনের গণতন্ত্র

0
মনজুর মোরশেদ রাহাত

বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিশন- ২০৩০ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার ফলে সারা দেশেই আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির এই ভিশন- ২০৩০ কে তাদের আইডিয়া কপি করা হয়েছে বলে দাবি করলেও কেউ কেউ একে পজিটিভভাবেই দেখছেন। তারা বলছেন বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটা সমস্যা হচ্ছে এখানে ‘মাস্টার প্ল্যান’ বলে কিছু থাকেনা। কারণ একটা সরকার কোন একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঁচ বছরের মেয়াদের মধ্যে সে কাজ শেষ করতে পারেনা।

ছবি: প্রতিকী

পরবর্তী সরকার পাঁচ বছর পরে ক্ষমতায় এসে অনেক ক্ষেত্রেই সেসব প্ল্যান বাদ দিয়ে আবার নিজেদের মতো করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে আগের সরকারের উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। তবে এই ক্ষেত্রে বিএনপি যদি আওয়ামীলীগের ভাল কাজগুলো কন্টিনিউ করার অঙ্গীকার করে তবে তা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটা নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা করবে। কারণ অতীতে কোন সরকারই আগের সরকারের শুরু করে যাওয়ার উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখার অতো উদারতা দেখাতে পারেনি।

এই দেশের জনগণ যে রাষ্ট্রের মালিক এই সত্যটি কৌশলে তাদেরকে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। জনগণ যাতে নিজেদেরকে রাষ্ট্রের মালিক না ভাবে প্রজা ভাবা শুরু করে সেই প্রচেষ্টা করা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। জনগণ এখন আর ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেনা। ভোটের নামে এখন এই দেশে তামাশা হচ্ছে। অথচ এই ভোটের মাধ্যমেই জনগণ তাদের মালিকানার বিষয়টি সরাসরি চর্চা করতো। তাই বিএনপি তাদের ভিশন -২০৩০ এর শুরুতেই ঘোষণা করেছে,

“বিএনপি মনে করে বাংলাদেশের জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল আজ সে রাষ্ট্রের মালিকানা তাদের হাতে নেই। তাই দেশের জনগনের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে চায় বিএনপি।” এমনকি তারা শুধুমাত্র ভোটদানের মাধ্যমে জনগণের যে ‘ওয়ান ডে ডেমোক্রেসি’র কন্সেপ্ট গড়ে উঠেছে সেখান থেকে বের হয়ে আসার ঘোষণাও দিয়েছে। তারা বলেছে, “আমরা ‘ওয়ান ডে ডেমোক্রেসিতে’ বিশ্বাসী নই। জনগণের ক্ষমতাকে কেবল নির্বাচনের দিন বা ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়না বিএনপি। নিত্যদিনের জন-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিয়ে তাদেরকে সম্পৃক্ত করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবো আমরা।”

বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়েছে যার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপি বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা খর্ব করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে,

“বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপর ন্যস্ত। এ রূপ ব্যবস্থা সংসদীয় সরকার পদ্ধতির স্বীকৃত রীতির পরিপন্থী। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করছে যে, প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এ রূপ অবস্থার অবসানকল্পে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।”

জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনমত উপেক্ষা করে সরকারি দলের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে তার থেকে বের হয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংবিধানে “গণ-ভোট” ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করার অঙ্গীকার করেছে তারা।
রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বারবার ‘সংখ্যালঘু’ তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে। অথচ সমানাধিকারের এই দেশে সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকতে পারেনা। কারণ এই দেশের সবার একটাই পরিচয়, তারা সবাই বাংলাদেশী। আর তাই বিএনপি তাদের ভিশন- ২০৩০ এ ঘোষণা করেছে, ” বিএনপি এমন এক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বিশ্বাস করে যেখানে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত হবে। যত সংখ্যালঘিষ্ঠই হউক না কেন, কোন মত ও বিশ্বাসকে অমর্যাদা না করার নীতিতে বিএনপি দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ।”

তারা তাদের ভিশনে বলেছে, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপি। এজন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে (Social Contract) পৌঁছাতে বিএনপি সচেষ্ট হবে।

বিএনপির যে ঘোষণাটি তরুণ সমাজকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তা হলো বিএনপি বাংলাদেশকে একটি Rain-Bow Nation এ (রঙধনু-জাতিতে) পরিণত করবে। এ প্রসঙ্গে তারা তাদের ভিশন- ২০৩০ এ বলেছেন, “শরতের আকাশে সাতটি রঙের বিচিত্র প্রভা নিয়ে রঙধনু যেভাবে মনোরম সৌন্দর্যের বিচ্ছূরণ ঘটায়, আমরা চাই সকল মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন ও পরিপুষ্ট করতে যে সংস্কৃতি বাংলাদেশকে একটি Rain-Bow Nation এ (রঙধনু-জাতিতে) পরিণত করবে।” এই কথাটি তরুণ সমাজকে আলোড়িত করার বেশ কিছু কারণ আছে। কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ চরম মাত্রার ঘৃণা আর বিভাজনের রাজনীতির চর্চা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কখনো এই মাত্রার অপরাজনীতির চর্চা করা হয়নি। এখানে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে গিয়ে ভাইকে ভাইয়ের শত্রু বানানো হয়েছে। অথচ এই দেশের সাধারণ জনগণ কখনোই মনের মধ্যে এই ধরণের ঘৃনা পোষণ করে রাখেনি। মুক্তিযদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, ইসলামের পক্ষ বিপক্ষ, পাহাড়ি আদিবাসী বলে বিভাজিত করা, স্কুল মাদ্রাসাকে পক্ষে বিপক্ষে দাঁড় করানো, বিরোধী মতকে বা সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যেকোন শক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, জঙ্গিবাদের দোসর আখ্যা দেয়া বা কোন বিশেষ পক্ষের এজেন্ট ঘোষণা দিয়ে জাতিকে বিভাজিত করার চেষ্টা হয়েছে, ঘৃণার রাজনীতির চর্চা করা হয়েছে। অথচ দিনশেষে আমরা সবাই বাংলাদেশী। আমরা আমাদের যেকারো বিপদ আপদে কিংবা আনন্দ উৎসবের সময়ে দল মত, জাতি ধর্ম, পাহাড়ি বাঙ্গালী নির্বিশেষে সবাই একসাথে শরীক হই। বাংলাদেশী পরিচয়ের মাধ্যমেই আমাদের সব বিভাজন ঘুচে যায়।

ভিশন-২০৩০ এ তারা বলেছে, “জাতির সকল অংশ তথা ধর্মীয়, আঞ্চলিক ও নৃ-গোষ্ঠীগত পরিচয় এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে একটি সুসংহত জাতি গঠন করাই বিএনপি’র লক্ষ্য। বিএনপি চায় বিভক্ত হয়ে পড়া এ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। তাই সকল মতাদর্শের ঐকতান রচনার জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার সেতুবন্ধ রচনাই হবে বিএনপি’র প্রয়াস।”

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।