অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

খুন গুম অপহরণ নিখোঁজ ও উদ্বেগে পার হলো ২০১৭ সাল

0
.

আর মাত্র দুইদিন পর বিদায় নেবে ২০১৭ সাল। বিদায়ী বছরজুড়ে দেশব্যাপী আলোচনায় ছিলো নিখোঁজ-গুম ও অপহরণ। শুধু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা সাংবাদিকই নন, নিখোঁজ-গুম ও অপহরণের তালিকায় রয়েছে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক এমনকি রাস্তার ভিক্ষুক। দীর্ঘ তালিকার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পেলেও অধিকাংশই ছিলো অপ্রকাশিত। এদের মধ্যে কপাল গুণে কেউ ফিরে এলেও না ফেরার তালিকাটাই দীর্ঘ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম উদাসীনতা এবং তাদের তৎপরতার অভাবে নিখোঁজ-গুম ও অপহরণ ঘটেই চলেছে।

এসবের কাউকে তুলে নেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আবার কেউ কেউ হঠাৎ করেই হয়েছে নিখোঁজ। আবার বাঁচা-মরার হিসাব নিকাশে কারো মিলছে লাশ। একটি ঘটনা ভুলে যাওয়ার আগেই ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। ‘নিখোঁজরা ফিরতে শুরু করেছে’ সরকারের পক্ষ থেকে এমনটি মন্তব্য করা হলেও বছরের শেষের দিকে চলতি ডিসেম্বরে কয়েকটি নিখোঁজ, অপহরণ বা গুমের ঘটনা জনমনে আতংক বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) তথ্যমতে, ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ২০৯টি।

এর মধ্যে ১৬৭ জন পুরুষ, ৩১ জন নারী এবং ১১ জন শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে। সংস্থাটির মতে, এই সময়ে নিখোঁজ হয়েছে ১১৬ জন নারী-পুরুষ। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্যমতে, গত ১০ বছরে এ ধরনের ৫৪৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন যার মধ্যে ৩৯৫ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নিখোঁজ হয়েছেন ৫০ জন, যাদের ৩৮ জনের খোঁজ মেলেনি। তবে নিখোঁজ কিংবা অপহরণের শিকার কারও জন্যই কোনো ধরনের মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি।

.

অন্যদিকে সরকারের বিরোধী প বিএনপির অভিযোগ, বর্তমান সরকারের আমলে তাদের ৭৪৭ জন নেতাকর্মী অপহৃত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন’ হয়েছেন ৫২০ জন, ১৫৭ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। ২২ আগস্ট মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় বনানী ওভারপাসের নিচে একটি মাইক্রোবাসে থাকা বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদ ও তার ছেলের পথরোধ করে অন্য আরেকটি মাইক্রোবাস। এরপর সেই মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন নেমে সাদাতকে জোর করে নামিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়।

এ ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি অপহরণ মামলা করা হলেও গত চার মাসে কেউ ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করেনি। তার খোঁজও মেলেনি। চলতি বছরে আলোচিত নিখোঁজের ঘটনার মধ্যে রয়েছে লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ফরহাদ মজহারের ঘটনা। ৩ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টায় নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। তাকে উদ্ধারের পর শুরু হয় নানা বিতর্ক।

দীর্ঘ ১০ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ জানায়, ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছিলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক এ ঘটনাকে ‘নাটক’, ‘মিথ্যাচার’, ‘সাজানো গল্প’ বলে উল্লেখ করেন। আইজিপি দাবি করেন ‘ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছেন, সরকারকে বিব্রত করার জন্য। এ ঘটনার পাঁচ মাস পর অবশেষে ৯ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি নাটক করিনি, আমাকে যা বলা হয়েছে, তাই করেছি। গত ২৩ আগস্ট থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় আইএফআইসি ব্যাংকের কর্পোরেট কমিউনিকেশন ও ব্রান্ডিং বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদের। তার পরিচিতজনরা বলেছেন, শামীম আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে থেকে ‘খানাবাসমতি’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার উদ্দেশে বের হন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।

এ ঘটনার পরদিন পল্টন মডেল থানায় জিডি করেন তার স্ত্রী শিল্পী আহমেদ। তবে হঠাৎ করেই সাতদিন পর ৩০ আগস্ট অত অবস্থায় বাড়ি ফেরেন শামীম। অন্যদের মতো তিনিও নিখোঁজের বিষয়ে সাংবাদিক কিংবা পুলিশকে কিছুই বলেননি। গত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে খেতে ধানমন্ডির স্টার কাবাবে গিয়েছিলেন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় শিার্থী ইশরাক আহমেদ (২০)। খাওয়া শেষে আর বাসায় ফেরেননি। এখনও নিখোঁজই রয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় তার বাবা জামালউদ্দিন আহমেদ ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেন। এখনো তার সন্ধান মেলেনি।

২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান নিখোঁজ হন। চার মাস নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ২২ ডিসেম্বর গুলশান থেকে তকে গ্রেফতার করা হয়।

নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ওপর হামলা চেষ্টার অভিযোগে গুলশান থানায় দায়ের হওয়া নাশকতার একটি পুরোনো মামলায় ঢাকা মহানগর আমিনুর রহমানকে গ্রেফতার দেখায়। তবে এতদিন কোথায়, কিভাবে ছিলেন তিনি তা রহস্যই থেকে গেছে। গত ১০ অক্টোবর মতিঝিল এলাকা থেকে নিখোঁজ হন পূর্ব-পশ্চিম বিডিডটকম এর সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল দাস। গত ১৯ ডিসেম্ব^র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভুলতা এলাকায় তাকে পাওয়া যায়। প্রথমে তিনি বলেছিলেন, ঘুরতে গিয়েছিলেন, পরে স্বীকার করেন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার কাছ থেকেও স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত ৭ নভেম্বর নিখোঁজ হন নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক মোবাশ্বার হাসান সিজার। গত ২১ ডিসেম্বর রাত ১টার দিকে রাজধানীর দণি বনশ্রীর জে-ব্লকের ১২/৩ সড়কের বাসা ২৫ নং নিজের বাসায় ফিরে আসেন এই শিক। তার বক্তব্যও রহস্যাবৃত।

এ মাসের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে কাতার ও ভিয়েতনামে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান তার বেলজিয়াম ফেরত মেয়েকে আনতে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হন। তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরপর থেকে নিখোঁজ হন তিনি। পুলিশ জানায়, তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে সর্বশেষ লোকেশন ছিলো বিমানবন্দরে কাছেই কাওলা নামক স্থানে। পরদিন রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকা থেকে তার গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। নিখোঁজের ৮ দিন পর গত মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) এক বৃদ্ধা ভিুকের লাশ উদ্ধার করেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশ। নিহত ভিুকের নাম মালেকা বেগম (৬৫)। মঙ্গলবার দুপুরে স্থানীয়দের দেয়া সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।

সে গোদাগাড়ী উপজেলার উজানপাড়া গ্রামে তার ছেলে মানিক চাঁদের বাড়িতে থাকতেন। গত মঙ্গলবার থেকে নিখোঁজ রয়েছে ব্রাক ব্যাংকের শ্যামলী শাখার সিনিয়র অফিসার নাইমুল ইসলাম সৈকত। তার পরিবারের প থেকে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চাল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মঙ্গলবার সকালে শ্যামলী থেকে এক বন্ধুর সঙ্গে শিল্পাঞ্চল এলাকায় এসেছিলেন সৈকত। সেখানে কাজ শেষ করে গুলশান তেজগাঁও লিংক রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার কথা বলে তিনি বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

গত রবিবার (২৪ ডিসেম্বর) রাত ১১টার দিকে মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় নাসির মিয়া (২১), রাসেল গাজী (২০) ও আবু হানিফ (১৪) নামে তিন তরুণ। অজ্ঞাতব্যক্তিরা তাদের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যদর্শী ও পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন।

এ নিয়ে থানায় জিডি নেয়নি বলে নিখোঁজ এক পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। তিন তরুণের পরিবারের সদস্যরা জানান, রবিবার রাত ১১টার দিকে মহাখালী ওয়্যারলেস এলাকা থেকে সাদা রঙের একটি হায়েস মাইক্রোবাসে করে তিন জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা থানা পুলিশ ও ডিবি কার্যালয়ে গিয়েও কারও কোনও খোঁজ পাননি। তাদের গ্রেফতার বা আটক করা হয়নি বলে পরিবারের সদস্যদের জানায় পুলিশ। অবশ্য গত মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্ব^র) বিকালে র‌্যাব-২ এর প থেকে পাঠানো এসএমএস ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তিন তরুণসহ চার জনকে গ্রেফতারের কথা বলা হয়।

সোমবার সন্ধ্যায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তাদের বিরুদ্ধে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেন, গুম-অপহরণের ফলে জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। বেশির ভাগ ঘটনায় অভিযোগের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে যায়। অনেক সময় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তির বিরোধের জের ধরেও এমন ঘটনা ঘটে। এতে সরকারও বিপাকে পড়ে। উভয় ক্ষেত্রেই সরকারকে সচেতনভাবে দায়িত্ব নেয়া উচিত। সুত্রঃ দিনকাল