অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

৭১’র বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী আর নেই

0
.

একাত্তরের বীরাঙ্গনা ও বিশিষ্ট লেখিকা রমা চৌধুরী আর নেই। আজ সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) ভোর ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।  মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালে তাঁর সাথে থাকা দীর্ঘদিনের সহচর ও তার বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দীন খোকন।

তিনি জানান,’শনিবার দুপুরের দিকে দিদির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাকে কেবিন থেকে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২৫ আগস্ট তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ২৯ আগস্ট তাকে আইসিইউ থেকে আবার কেবিনে আনা হয়। সেখানে তরল জাতীয় খাবারও দেওয়া হচ্ছিল তাকে।’ গতকাল রবিবার সন্ধ্যার দিকে শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু ভোর ৪টার দিকে তিনি মারা যান।

তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, সংগ্রামী এই নারী রমা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরণের জটিল রোগে ভুগছেন। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে- পিত্তথলীতে পাথর, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, পেটে ক্ষত, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ। বয়সের কারণে পিত্তথলীর পাথর অপসারণ করা যাচ্ছে না বলে তিনি এ থেকে ব্যাথায় ভুগছেন।

তিনি স্বাভাবিক খাবারও গ্রহণ করতে পারতেন না। এর আগেও তাকে দুই দফা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

একাত্তরের জননীসহ ১৮টি গ্রন্থের লেখক রমা চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৩ মে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোপাদিয়া গ্রামের বাড়িতে রমা চৌধুরীর ওপর নির্যাতন চালায় পাক বাহিনী। রমা চৌধুরী একজন স্বাধীনচেতা নারী হিসেবে কখনও কারো কাজ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেননি। তিনি এক সময় বই ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।

.

রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) নারী। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন চার ছেলে সাগর, টগর, জহর এবং দীপংকরকে নিয়ে ছিল তার সংসার।

১৯৭১ সালের ১৩ মে ভোরে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। সম্ভ্রম হারানোর পর পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেছিলেন। হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে সম্ভ্রমও হারানোর পাশাপাশি দুই ছেলেকে হারান তিনি। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তার ঘর-বাড়ি। তবুও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি এ বীরাঙ্গনা। শুরু করেন নতুনভাবে পথচলা। লিখে ফেলেন একে একে ১৮টি বই। এসব বই বিক্রি করেই চলত তার সংসার। তিনি তার উপর নির্যাতনের ঘটনা “একাত্তরের জননী” নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন।

স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। সেই পেশা এখনো বর্তমান। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

.

কোমরের আঘাত, গলব্লাডার স্টোন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি রমা চৌধুরী ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।

জানাগেছে, হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করতেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পড়েননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর গত ১৭ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী।

এদিকে রমা চৌধুরীর মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রামের সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।  তাঁর মরদেহ আজ সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। সেখানে রমা চৌধুরীকে সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন।