কর্মগুণে হাজার বছর বেঁচে থাকবেন সাংবাদিক হেলাল হুমায়ুন
মানুষের জীবনও শামুকের মতো। শামুকের আবরণ ভাঙলে যেমন দামি মুক্তা বেরিয়ে আসে, তেমনি মানুষ মারা গেলেই যেন বেরিয়ে আসে তিনি কত বড় মানুষ ছিলেন। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় অনেকটা আকষ্মিকভাবে পরপারে পাড়ি জমালেন দৈনিক নয়া দিগন্তের চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ ও চট্টগ্রামের প্রথিতযশা সাংবাদিক আলহাজ্ব হেলাল হুমায়ুন। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন বরং একজন সফল উদ্যোক্তা, সংগঠক, শিক্ষানুরাগী ও সমাজদরদী হিসেবে সমধিক পরিচিত। নিজ কর্মগুণে ব্যক্তি থেকে রীতিমত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন এ ব্যক্তিত্ব। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হেলাল হুমায়ূন তার নিজগ্রাম সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করেছেন আল-হেলাল আদর্শ ডিগ্রি কলেজ, আল-হেলাল মহিলা মাদ্রাসা ও আল-হেলাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় আজ থেকে ১১ বছর আগে। তখন আমি ভোরের কাগজে কাজ করছি। আমাদের এলাকায় তখন পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে দৈনিক নয়া দিগন্ত। পত্রিকাটির মূল্য ছিলো ৫ টাকা। বেশ ঝকঝকে পত্রিকার সাথে প্রতি সপ্তাহে দুটি ম্যাগাজিন। একটি অবকাশ, অপরটি থেরাপী। আমরা বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। মফস্বলের তরুণদের কাছে একটি স্বপ্নের পত্রিকা ছিল নয়া দিগন্ত। আমি ভোরের কাগজ ছেড়ে নয়া দিগন্তে যোগ দেই।
নয়া দিগন্তের লোহাগাড়া উপজেলা প্রতিনিধি হিসিবে কাজ করার সময় চট্টগ্রাম অফিসে তার সাথে কথা হলে লক্ষ্য করেছি, তাঁর জানার পরিধি ছিল অনেক বেশী। বিশেষ করে তার টেবিলে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিয়ে নূহ উল আলম লেনিনের লেখা বই যেমন ছিল, তেমনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বিএনপির রাজনীতির উপর লেখা বইও থাকত।
উনার সাথে পরিচিতজন মাত্রই স্বীকার করবেন, হেলাল হুমায়ুন ছিলেন বহুমুখী পান্ডিত্যের অধিকারী। উর্দু ও ফার্সি ভাষায় তার দখল ছিল উল্লেখ করার মতো। এ জন্য তিনি বাংলা-উর্দু সাহিত্য পরিষদ, আল্লামা রুমী সোসাইটিসহ অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সংগঠনের সাথে উতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। নিজে একটি আদর্শের অনুসরণ করলেও জ্ঞানের ব্যাপ্তি ছিলো সকল ইজমের প্রাান্তসীমা পর্যন্ত। আমি দেখেছি, চট্টগ্রামের অনেক বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা তাঁর পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতেন।
দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র রিপোর্টার রফিকুল ইসলাম সেলিম বলেন, হুমায়ুন ভাই আদর্শের জায়গায় ছিলেন অবিচল। তিনি নিজে আড়ালে থেকে অনেক তরুণকে সাংবাদিক বানিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে পুলিশী হয়রানী থেকে অনেক সংবাদকর্মীকে রক্ষা করেছেন। তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ বললেও তিনি গায়ে মাখতেন না। তিনি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার। বাবার সম্পদ দিয়ে তিনি সারাজীবন বসে বসে খেতে পারতেন। কিন্তু তিনি দেখিয়ে দিেেয়েেছন, সাংবাদিকতা করেও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বচ্ছল জীবনযাপন করা যায়।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিএমইউজে) সভাপতি ও এনটিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শামসুল হক হায়দরি বলেন, ‘হুমায়ুন ভাইয়ের গ্রামে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় অনেক মানুষ উপস্থিত হবে জানতাম। কিন্তু চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের জানাজায় এতো বেশি মানুষের উপন্থিতি প্রমাণ করে, তিনি সাংবাদিকদের মধ্যে কতটুকু জনপ্রিয় ছিলেন। শুুধু তাই নয়, প্রেস ক্লাবের জানাজায় ভিন্ন মতের সাংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলেন। আসলে পেশাগত কাজে তিনি দল-মতের উর্দ্ধে উঠে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।’
আমি তখন ঢাকায়। ফেসবুকে একজন জানালেন, হুমায়ুন ভাই আর নেই। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেননা, কয়দিন আগেও তাঁর সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। সুস্থ-সক্ষম মানুষ হুট করে নেই হয়ে গেল ভাবতেই গা শিউরে উঠল। নিকট অতিতে অন্যকোনো মৃত্যু সংবাদ আমাকে এতোটা বিচলিত করেনি।
হুমায়ুন ভাইয়ের মৃত্যুর পর বেরিয়ে এলো অনেক অজানা তথ্য। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র জামাল খাঁন এলাকায় যে প্রেস ক্লাব ভবনটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেটার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদানটি হুমায়ুন ভাইয়ের। এমন তথ্য উঠে এসেছে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত স্বরণ সভায়। এ সভা থেকে আরো জানা গেল, সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপষহীন। একজন হেলাল হুমায়ুন লোকান্তরে যাবার পর সাংবাদিকরা টের পাচ্ছেন তিনি কত বড় অভিভাবক ছিলেন। অশ্রুসজল চোখে এমনটাই জানালেন সাংবাদিকরা।
সিএমইউজে সেক্রেটারি শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘হুমায়ুন ভাইয়ের মতো মানুষ মেেঞ্চ বসলে পুরো অনুষ্ঠান আলোকিত হয়ে যেত, অথচ তিনি সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করতেন।’
আমি বিশ্বাস করি, যতদিন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রামের সংবাদ-সাংবাদিকতা থাকবে, যতদিন চট্টগ্রামে সাহিত্যচর্চা থাকবে, যতদিন চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন থাকবে, যতদিন সাতকানিয়া আল হেলাল আদর্শ ডিগ্রি কলেজ, আল হেলাল মহিলা মাদ্রাসা, আল হেলাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকবে, সর্বোপরি যতদিন দৈনিক নয়া দিগন্ত থাকবে ততদিন আপনি বেঁচে থাকবেন এ সবের মাঝে। হাজার বছর ধরে আপনি থাকবেন এসব প্রতিষ্ঠানের অস্বিত্বের মাঝে।
প্রিয় হুমায়ুন ভাই, আপনি যেখানে গিয়েছেন, সেটাই আমাদের সকলের আসল গন্তব্য। মহান আল্লাহ আপনার সৎকাজগুলো ক্ববুল করে আপনাকে জান্নাতের বাসিন্দা করুন। আমিন।
লেখক: এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সাংবাদিক, দৈনিক নয়া দিগন্ত