অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

চট্টগ্রাম ১৪ঃ এক অলির সামনে ওরা ১১ জন

0
.

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে রাজনীতির নয়া মেরুকরণে আগামী সংসদ নির্বাচন কর্ণেল কলির জন্য আগাম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তার প্রতিপক্ষরা। এক অলির সামনে ভোটের মাঠে লড়তে আগ্রহী ১০ থেকে ১১জন।

চন্দনাইশ উপজেলাসহ দুই পৌরসভা ও সাতকানিয়া (আংশিক) নিয়ে চট্টগ্রাম-১৪ সংসদীয় আসন। নৌকার মাঝি হতে আগ্রহীদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সাংসদ নজরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর ও রিহ্যাব চট্টগ্রামের সভাপতি ও ব্যবসায়ী আবদুল কৈয়ুম চৌধুরী।

অন্যদিকে বিএনপিতে কেন্দ্রীয় বিএনপির পরিবার ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক মহসিন জিল্লুর করিম, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মিজানুল হক চৌধুরীর নাম শোনা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল নবী ও এরশাদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় মহাজোট থেকে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব স উ ম আবদুস সামাদ প্রার্থীী হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এই আসনে ২০-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি ও সাবেক বিএনপির সরকারের মন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম।

এদিকে চট্টগ্রাম-১৪ জামায়াতের এবং চট্টগ্রাম-১৩ আলহাজ ড. কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীর বিক্রমের ঘাঁটি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। এই দুটো আসনে জামায়াতের সাথে ড. অলির সম্পর্ক বরাবরই সাপে-নেউলে। এ দুটো আসনে নতুন মুখ নিয়ে জামায়াত-এলডিপিকে চ্যালেঞ্জ করতে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, ১৯৯১ সালে বিএনপি প্রার্থী মোস্তাফিজ চৌধুরী ও আওয়ামীলীগ প্রার্থী আখতারুজ্জামানকে চৌধুরী বাবুকে হারিয়ে শাহজাহান চৌধুরীর জয়ের মধ্য দিয়ে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় জামায়াতের রাজত্ব শুরু হয়। সরকার গঠনে কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপিকে জামায়াত সমর্থন দিলেও চট্টগ্রাম-১৩ ও ১৪ আসনে বিএনপি-জামায়াত দূরত্ব রয়ে যায়।

চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সাংসদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, শহীদ জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা, বিএনপি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদকে নিয়ে এ অঞ্চলের বিএনপি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম-১৩’র পাশাপাশি চট্টগ্রাম-১৪ আসনেও নির্বাচন করে জিতে যান বিএনপি নেতা অলি আহমদ বীর বিক্রম। সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এক পর্যায়ে সারাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলনে চারদলীয় জোট গঠিত হলে সমগ্র বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া-চন্দনাইশে তা হয়নি।

.

২০০১ সালে অনেকটা একক সিদ্ধান্তে অলি আহমদ দুটো আসনে নির্বাচন করে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় হেরে যান। এতে দল, সরকার ও সংসদীয় এলাকায় তার প্রভাব-মূল্যায়ণ কমে যায়। এক পর্যায়ে বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠন করে মহাজোটে শামিল হন। এতে স্থানীয় বিএনপির বিপর্যস্ততা শুরু তখন থেকেই। সিংহভাগ বিএনপি নেতা-কর্মী তার সাথে পাড়ি জমান এলডিপিতে। বাকি বিএনপি দুভাগে ভেঙে যায়। একভাগ অলিভক্ত অপর ভাগ অলি বিরোধী হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পায়। উভয় অংশই নিজেদেরকে বিএনপির মূলধারার কান্ডারি দাবি করে বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনেও অলি আহমদ উভয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় জামায়াত নেতা শামসুল ইসলামের কাছে হেরে যান। সে নির্বাচনে মহাজোটও তাকে মূল্যায়ন করেনি।

অপরদিকে তার নিজের ঘরেই দাঁড়িয়ে যান তার প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের ভাই ডা. মহসিন। তিনি সাতকানিয়া-চন্দনাইশে বিএনপির বড় এক অংশ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু করে।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কর্নেল অলি আহমদ বিএনপিতে যোগ দেন। ওই বছরের মার্চে চট্টগ্রাম-১৩ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া) আসনের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জেনারেল জিয়ার মন্ত্রিসভায় নিয়োগ পান প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। এরপরে একই আসন থেকে আরও চার দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন অলি আহমদ। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠদের একজন কর্নেল অলি।

১৯৮৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে দলের সঙ্গে মতভেদ সৃষ্টি হলে ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর অলি আহমদ বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজাকে চৌধুরীকে নিয়ে গঠন করেন বিকল্পধারা। পরে ওখান থেকে বেরিয়ে এলডিপি গঠন করেন তিনি। সেই থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচনে এলডিপি থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন অলি আহমদ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। অলি আহমদকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি করা হলেও ২০১২ সালে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে গিয়ে চট্টগ্রাম-১৪ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৩ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া) আসনে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন অলি আহমদ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-১৪ আসনে পরাজিত হলেও চট্টগ্রাম-১৩ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের বিপুল ভোটে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

ওই নির্বাচনে অলি আহমদের ছাতা প্রতীকে ভোট পড়ে ৮২ হাজার ৩৩টি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফসার উদ্দিন আহমদের নৌকা পায় ৬১ হাজার ৬৩৬টি ও বিএনপির প্রার্থীী মো. মিজানুল হক চৌধুরীর ধানের শীষ প্রতীকে ভোট পড়ে ৩৩ হাজার ৩৫টি। চট্টগ্রাম-১৪ আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট মনোনীত জামায়াতের প্রার্থী আ ন ম শামসুল ইসলামের কাছে পরাজিত হলেও ড. অলি আহমদ ভোট পান ৬২ হাজার ৭৯০টি। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৪৯ হাজার ৫০৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন।

এদিকে গত দুই বছর নানা আলোচনাতেই রাজনীতির মাঠে এলডিপি সভাপতি অলি আহমেদ সরব ছিলেন। গত বছরের জানুয়ারিতে বৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিও (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম-১৪ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামীলীগ সমর্থনপুষ্ঠ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠেনি বলে অভিমত সাংসদের। এলাকায় তিনি প্রায় ৫হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন বলে তার দাবি। তিনি আরো দাবি করেছেন, শঙ্খ নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ করে ঐ এলাকার মানুষের কান্না থামিয়েছেন। নির্মান করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা।

চট্টগ্রাম-১৪ সংসদীয় আসন হল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার একটি। এটি চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত জাতীয় সংসদের ২৯১ নং আসন।

চট্টগ্রাম-১৪ আসনটি চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলা এবং সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া, কালিয়াইশ, বাজালিয়া, ধর্মপুর ও খাগারিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।

চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যর্থতার অভিযোগ প্রসঙ্গে এমপি বলেন, এ দ্বন্দ্ব দীঘদিনের জিইয়ে রাখা দ্বন্দ্ব। চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর ও সাধারন সম্পাদক আবু আহমেদ হলেন মামা-ভাগিনা। তারপরও কেউ কারো মুখ দেখতে পছন্দ করেন না। জাহেদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকেন। দলীয় কর্মকান্ডে তাকে পাওয়া যায়না। এখান থেকেই দ্বন্দ্বের শুরু। তবে এবার দল থেকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ নিশ্চিত বলে জানান এমপি নজরুল ইসলাম।

অন্যদিকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মফিজুর রহমান। তিনি ২০১৩ সাল থেকে এ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানান। কেন প্রত্যাশী, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন করলেই রাজনীতিতে পরিপূর্ণতা আসে। সাংসদ হলে একটা বড় পরিসরে মানুষের জন্য কাজ করা যায়।

মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে কি করবেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দল থেকে একজন এমপি মনোনোয়ন পায়। তাই তার দলের প্রতি দায়বদ্ধতাও বেশি।  তৃণমুল থেকে উঠৈ আসা বলেই তিনি তৃণমুল নেতাদের প্রাধান্য সবসময়ই তার কাছে থাকবে বলেও জানান তিনি।

*শঙ্খের মতো ভাঙ্গতে পারে এমপি নজরুলের ভাগ্য, আগাম চ্যালেঞ্জ বিএনপির