অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

লালদিয়া চরে মানবতার নিরব কান্না

0
.

লালদিয়া চরে এখন নিরব কান্না চলছে। দীর্ঘ ৪৭ বছরের ভিটে-মাটি আর মাথা গোজার ঠাঁই সরকারকে ছেড়ে দিয়ে তাঁরা আজ নিঃস্ব। নেই মাথা গোজার ঠাঁই! নেই সহায়-সম্বল। দুঃখ-দারিদ্রতাকে বুকে ধারণ করেই প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করছে দু’হাজারের অধিক পরিবার। তার ওপর অতিরিক্ত চাপ, প্রতিনিয়ত নাড়া দিচ্ছে উচ্ছেদ আতঙ্ক।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে পুরো এলাকায়টিই এক প্রকার পানির নিচে চলে যায়। বাস্তবতা আর জীবন সংগ্রামের তাগিদে কোনোভাবে কূলধরে যুদ্ধ করে চলে বসবাস।

নগরীর পতেঙ্গা থানাধীন লালদিয়ার চরের বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধা মরিয়ম বেগম এজন। কথা হয় এ ছয়দশক পার করে আসা বৃদ্ধা মরিয়মের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়েই সংসার। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ছেলে বাইরে দিনমজুরী করে। যা আয়হয় তা দিয়ে কোনো ভাবে চলে মা-ছেলের সংসার। এ অবস্থায় যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। কোথাও কোনো ভিটে-মাটি নেই। সরকারকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছি বহু আগে, শুধুমাত্র এই ভিটে ছাড়া আমাদের আর থাকার জায়গা নেই। আজ আমরা নিঃস্ব, বলেই ঢুকড়ে ঢুকড়ে কাঁদছেন মরিয়ম।

বৃদ্ধা এই মরিয়মের কাছ থেকেই জানা যায়, ২০০৫ সালে ইনকনট্রেড লিমিটেডের একটি কন্টেইনার ডিপো নির্মাণের সময় ৫’শ পরিবারকে পুন:র্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ্এরপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্ত হন উচ্ছেদ হওয়ার পরিবারগুলো। উচ্চ আদালত নির্দেশ দেন বাস্তুহারা পরিবারগুলোকে পুর্ন:বাসন করার। সেই নির্দেশ এখনো বাস্তবায়ন করেনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এবার বন্দর জায়গাটি উচ্ছেদ করার নতুনভাবে কাজটির দায়িত্ব পড়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ওপর। এই নিয়ে আতঙ্কে ভূগছে চরের দু’হাজার পরিবার।

.

এ ব্যাপারে আইনে যা আছে :
দেশের প্রতিকূল দখল আইনে বলা হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য কারো (মালিকানাধীন) স্থাবর সম্পত্তিতে কোনো ধরনের চুক্তি বা অভিযোগ ছাড়া ১২ বছর বাহ্যিক ভাবে/ বাস্তবে দখল করে থাকে তখন তা এই দখলকে প্রতিকূল দখল বলে। উল্লেখ্য এই দখলদার পরে ওই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারে। আর্টিকেল ১৪২ অব লিমিটেশন অন অ্যাক্ট।

চসিক মেয়রকে স্মারক লিপিঃ
উচ্ছেদের আতঙ্ক থেকে মুক্তি ও ন্যায্য ভূমি অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনকে মাস খানেক আগে স্মারকলিপি দিয়েছে রালদিয়ার চরের বস্তুহারা পরিবারগুলো। দু’হাজার পরিবারের দাবি, তাদের স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হোক। যেখানে বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি পরিবারকে একটি খামার, একটি ঘর নিমার্ণের পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেখানে আমাদেরকে একটুকরো থাকার জায়গা দিলেই চলবে। আমরা সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

লালদিয়ার চরের অধিবাসিদের দাবিঃ
সরকার যেখানে লাখ লাখ রোহিঙ্গাদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে, সেখান আমরা এই দেশের নাগরিক। আমরা কোনো আবাসনের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হব? এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরশেনের মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে লালদিয়ার চরবাসী ঐ জায়গায় ওপর বসবাস করছে প্রায় দু’হাজার পরিবার। তাদের যদি সেখান থেকে উচ্ছেদ করতেই হয়, তাহলে অবশ্যই অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা মানবিক ব্যাপার। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।

.

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশনা মেনে লালদিয়ার চর এলাকায় উচ্ছেদের ব্যাপারে প্রস্তুতি চলছে। লালদিয়ার চরবাসী যদি তাদের বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে আদালত থেকে উচ্ছেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনতে পারে, তাহলেই অবশ্যই উচ্ছেদ থেকে রক্ষা পাবে। অন্যাথায় আইন কারো জন্য থেমে থাকবে না।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, লালদিয়ার চরের ভূমিটি বন্দরের নিজস্ব জায়গা। সেখানে বসবাসরতদের কারো বৈধ কাগজপত্র নেই। তারপরও তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হলে অন্যত্র পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানান।

উল্লেখ্য: স্বাধীনতার পর বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি এলাকায় বসবাসরত ২২শ’ পরিবারকে সরকার অধিগ্রহণ করে পতেঙ্গা লালদিয়ার চর এলাকায় তাদের পুন:র্বাসন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে থেকেই সেখানে তাদের বসবাস। তবে নেই কোনো স্থায়ী ভিটে-মাটি বা নিজের দাবি করার মতো কোনো বৈধ কাগজ।