অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

চট্টগ্রাম আদালতে বিচারক সংকট, ভোগান্তি বিচারপ্রার্থীদের

0
.

চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার প্রায় বিশটি আদালতে দীর্র্ঘদিন যাবত বিচারক শূন্যতায় কারণে বাড়ছে মামলার জট। এতে করে ভোগন্তি বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের।  এ নিয়ে আইনজীবি ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত বিজ্ঞ বিচারক দিয়ে চলছে চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদালত সমূহের বিচার কাজ। দৈনন্দিন আদালত-গুলোতে বিজ্ঞ বিচারক সংকটের কারণে পুরনো মামলার যেমন নিষ্পত্তি হচ্ছে না তেমনি প্রতিদিন নতুন মামলা দায়ের হওয়ায় বাড়ছে মামলার জট। এর ফলে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে থাকা প্রায় ৩০ হাজার মামলায় ধুলি জমে গেছে । বর্তমানে ৯০ টি আদালতের মধ্যে প্রায় ২০টি তে নেই বিচারক।

বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে চট্টগ্রাম বিভাগের দুর্নীতি ও চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।  বর্তমানে আদালতটিতে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ৭শ’র অধিক মামলা। তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা প্রায় আড়াইশ মামলার তদারকি করছে । বিশেষ এই আদালতে এখন চলছে বিচারক সংকট।

জানা যায়, গত ৭ই জানুয়ারি এই আদালতের বিজ্ঞ বিচারক রুহুল আমিন বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন ।

বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল অত্যন্ত গুরত্বপুর্ণ একটি আদালত যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যান্য আদালত থেকে গুরুত্বপূর্ণ মামলা দ্রুত নিস্পত্তির জন্য বদলী করা হয় । বর্তমানে এই ট্রাইবুনালে ও বিচারক শুন্য থাকায় প্রায় ১শ’র বেশি গুরুত্বপূর্ণ চাঞ্চল্যকর মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারী বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারক মোঃ মহিতুল হক এনাম চৌধুরীকে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে বদলি করার পর থেকে এই ট্রাইব্যুনালের বিচারক সংকট শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিচারক শূন্য থাকার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিজ্ঞ বিচারক হোসনে আরা বেগমকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাজে যোগ না দিয়ে তিনি অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে যান। পরবর্তীতে আবার গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর বিজ্ঞ বিচারক মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে উক্ত ট্রাইবুন্যালে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ৎ। কিন্তু তিনি মাত্র দুই মাস কাজ করার পর গত বছরের নভেম্বরে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। এরপর থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল বিচারক শূন্য আছে ।

অপরদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ চট্টগ্রামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত ও পারিবারিক আদালতে বিজ্ঞ বিচারক শূন্য থাকায় বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশী মামলা। এতে করে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় সকল মামলার পক্ষগণকে। কিন্তু বর্তমানে ৭টি নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দূর্ভোগ কমতে শুরু করেছে। পারিবারিক এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করার আইনী বিধান রয়েছে কিন্তু বিজ্ঞ বিচারক সংকট থাকায় তা উপেক্ষিত হয়েছিল। বিভিন্ন আদালতে বিচারক না থাকায় দিনের পর দিনে মামলার নতুন নতুন তারিখ পড়তে থাকে। একই সাথে প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা দায়ের হওয়ায় মামলার জট আরও বেড়ে গিয়েছে। বিজ্ঞ বিচারক না থাকায় মামলার বিচার কাজ সম্ভব হয়নি। ফলে নতুন তারিখ নির্ধারণ করেই মামলা রেখে দেয়া হয়। ফলে পুরানো মামলা যেমন নিস্পত্তি হয়নি তেমনি প্রতিদিন নতুন মামলা যোগ হওয়ায় বেড়েছে জট।

মামলার চাপ ও জট বাড়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর দাবীও জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও চট্টগ্রামের আর ১৮ টি আদালতে রয়েছে বিচারক সংকট। তার মধ্যে জেলা জজশিপের অধীনে দেউলিয়া আদালত, ৩য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, সন্দ্বীপের সিনিঃ সহঃ জজ, পটিয়া চৌকির আওতাধীন চন্দনাইশ আদালতের সহঃ জজ, পটিয়া চৌকির অতিঃ আদালতের সহঃ জজ, সাতকানিয়া চৌকির অতিঃ আদালতের সহঃ জজ, সাতকানিয়া চৌকির লোহাগড়া আদালতের সহঃ জজ, বাশঁখালী চৌকির সহঃ জজ আদালত গুলোতে রয়েছে বিচারক সংকট। তাছাড়াও ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ অতিঃ মহানগর দায়রা জজ এবং চীফ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে ২য় জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে বিচারক নেই। এই ১৯টি আদালতে রয়েছে ২৯ হাজার মামলা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাজিমউদ্দীন চৌধুরী গত বছর ২২/০৭/১৮ এক জরুরী বার্তায় দ্রুততম সময়ে বিচারক নিয়োগ করে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতি, আইন মন্ত্রী, আইন সচিব, বাংলাদেশ বার কউন্সিল বরাবরে প্রেরিত এক জরুরী বার্তায় অনুরোধ জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় বিচারপ্রার্থী জনগণ চলমান দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চায়।

সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন আদালতের বিচারক সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে উদ্বেগ করেছে সংগঠনটি। একই সাথে দ্রুত বিচারক নিয়োগ ও নতুন আদালত সৃষ্টিসহ কয়েকটি সুপারিশ করেছে বিএইচআরএফ।

বিএইচআরএফ এর তৈরী করা মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ সংকট নিরসনে জরুরী ভিত্তিতে অভিজ্ঞ আইনজীবীদের থেকে ল’ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ নিয়োগের সুপারিশ পেশ করেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের পক্ষে এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্‌সান।

রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয় যে, রাজধানী ঢাকায় ৭টি অর্থঋণ আদালত থাকলেও বাণিজ্যিক নগরী খ্যাত প্রধান বন্দর শহর চট্টগ্রামে একটি মাত্র অর্থঋণ আদালত রয়েছে। এখানে কমপক্ষে ৫টি অর্থঋণ আদালত স্থাপনের সুপারিশ রইল। সরকার ও রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় এনে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের বিচারক শূন্য আদালতে বিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ সম্ভব ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের পরিচালক (অর্গানাইজিং) এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্‌সান পাঠক ডট নিউজকে বলেন, বিচারক সংকটের কারনে ভোগান্তিতে পড়ছে মামলার বিপুল সংখ্যক বিচারপ্রার্থী জনগোষ্ঠী । দীর্ঘদিন ধরে বিচারক শূন্যতার কারণে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং বিচার প্রার্থী জনগোষ্ঠীর হয়রানী ও ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে । দূর-দূরান্ত এবং দুর্গম এলাকা থেকে আগত বিচার প্রার্থী জনগোষ্ঠী বিচারক না থাকায় শুধুমাত্র হাজির হয়ে তারিখ পরিবর্তনে বিদায় নিতে হয়, যা খুবই দুঃখজনক ।

বিভিন্ন আদালতে জটে আটকে পড়া মামলার সংখ্যাকে আনুপাতিক হারে হিসাব করলে দেখা যায়, সেখানে প্রয়োজন আর কিছু সংখ্যক নতুন আদালত। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নতুন আদালত সৃষ্টির পাশাপাশি বিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জেলা আদালতের আইনজীবি রাশেদুল ইসলাম চৌধুরী পাঠক ডট নিউজকে বলেন, প্রায় ২০টির অধিক আদালতে কোন বিচারক না থাকায় বিচার প্রার্থীরা বিপাকে পড়েছে। সেই আমরা আইনজীবিরাও বিব্রত অবস্থার মধ্যে আছি। হাজার হাজার বিচারাধীন মামলা রয়েছে যেগুলো আদালত না থাকার কারনে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছেনা। এ সকল আদালতে মামলার জট তৈরী হয়েছে। আমাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারক নিয়োগ দেযা হোক। মহানগর দায়রা জজ মেট্রো আদালতে বিচারক খুব বেশি প্রয়োজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইয়ূব খান পাঠক ডট নিউজকে বলেন, প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ থেকে চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজসহ প্রায় ২০টি আদালতে কোন বিচারক নেই। প্রায় ২৩ শতাংশ আদালতে বিচার কাজ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত এমন পরিস্থিতি চলে আসছে। শূণ্য আদালতে বিচারক চেয়ে আমি মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন দফতরে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথেও দেখা করা চেষ্টা করেছি। আমাদের আইনজীবি সমিতির দাবী অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারক নিয়োগ দেয়া হোক।