অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

নুসরাত হত্যাঃ এবার সন্দেহের তালিকায় ফেনীর এসপি

0
.

মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সন্দেহের তালিকায় পড়েছেন ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নুসরাতের পরিবারের বিরুদ্ধে দোষ চাপিয়ে সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। এই ঘটনায় তার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে নতুন কমিটি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

নুসরাতকে যৌন হয়রানির ঘটনায় আইনবহির্ভূত জিজ্ঞাসাবাদের অভিযোগে সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে যাওয়ার কথা রয়েছে পিবিআইয়ের একটি তদন্ত দলের।

এর মধ্যেই পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠালেন ফেনীর এসপি। তিনি ওসি মোয়াজ্জেমকে রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো চিঠিতে এসপি উল্লেখ করেছেন, মামলা করতে নুসরাতের পরিবারই নাকি কালক্ষেপণ করেছিল। এ ছাড়া তারা মামলার এজাহার দুই দফায় ঘষামাজা করেছে।

তার দেওয়া এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ফেনীর এসপির প্রকৃত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। বুধবার এ কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যদিকে নুসরাতকে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে কিনা তদন্ত করতে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি প্রতিনিধি দল এখন সোনাগাজীতে অবস্থান করছেন। তারা নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাস্থল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করছেন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদের ওই ভিডিওচিত্রে ওসি মোয়াজ্জেমের যে বক্তব্য, তা আইনবহির্ভূত ও পরোক্ষ যৌন হয়রানি। ওই ভিডিওচিত্রের ভিত্তিতে গত ১৫ এপ্রিল আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আইন বহির্ভূতভাবে নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের অভিযোগ আনা হয় মামলায়। এ বিষয়ে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে ইতোমধ্যেই পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

পিবিআই সূত্র জানায়, মামলাটি আদালতে হওয়ায় ওসিকে গ্রেফতারের বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভর করছে। তদন্ত সূত্র জানায়, পিবিআই এর এসপি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নারী সম্পর্কিত মামলা হওয়ায় এতে এক নারী কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পিবিআই প্রধান বনোজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘এ ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনায় যার যতটুকু সম্পৃক্ত বা অপরাধ পাওয়া যাবে তার ততটুকু শাস্তি হবে।’

উল্লেখ্য, মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে হত্যা চেষ্টার পূর্বে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির চেষ্টার অভিযোগ করতে গেলে ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসির দ্বারা আরেক দফা হয়রানির শিকার হয়েছিলেন নুসরাত বলে অভিযোগ উঠে। এই সংক্রান্ত একটি ভিডিও গত ১১ এপ্রিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এ ঘটনার পর সোনাগাজী থানার ওসি (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কামাল উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়।

এদিকে নুসরাত জাহান রাফির মতো একাধিক শিক্ষার্থী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার যৌন হয়রানির শিকার। তবে এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কমিটির পদক্ষেপ গ্রহণে গাফিলতি থাকায় সিরাজের আতঙ্কেই চুপ থাকেন শিক্ষার্থীরা বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ছাত্রী এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ শুধু নুসরাত জাহান রাফির সঙ্গেই এমন করেনি। আমাদের অনেকের সাথে এমন করেছে। ওনার একটা অভ্যাস ছিল এটা।

অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেও এই বিষয়ে মাদ্রাসা কমিটি কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ থাকেন এমন অভিযোগ করেছেন ছাত্রীরা। তারা বলছেন, নুসরাতসহ একাধিক শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও মাদ্রাসা কমিটির কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়না। এতে আরও বেপরোয়া ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। আবার কোনো প্রতিকার হতো না বলে ভয়ে অনেকে অভিযোগ করতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

এ দিকে ব্যর্থতার দায়ে মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদ বাতিলের দাবি উঠে। এ বিষয়ে ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহেদুজজামান সাংবাদিকদের বলেছেন, গভর্নিং বডি নিয়ে যে কথা উঠছে, যদি তাদের কোনো গাফিলতি থাকে তবে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রিপোর্ট পাওয়ার পরে কার কোথায় গাফিলতি ছিল এই বিষয়ে নিশ্চিত জানা যাবে বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তদন্তে দায়ী হলে মাদ্রাসা কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। পরে ওই মামলায় গ্রেফতার করা হয় অধ্যক্ষকে। গ্রেফতারের এই ঘটনার পর ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম (এইচএসসি) পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গেলে সেখানে পরিকল্পিতভাবে ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শরীরে জীবন্ত আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়।

শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে কয়েকজন বোরকা পরা নারী পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। তারা জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা মামলা তুলে না নেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় পুলিশকেও জানিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ওই দিন বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অধ্যক্ষ তার অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে ছাত্রীকে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। পরে পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের লোকজন ওই ছাত্রীর গায়ে আগুন দেয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। গত বুধবার ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।